৪ লাখ ৬৮ হাজার ২শ’ কোটি টাকার বাজেট আসছে

32

কাজিরবাজার ডেস্ক :
টানা তিন বছর সাত শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধি হবে বলে সরকার অনুমান করছে। এ অর্জনকেই ভিত্তি ধরে সরকার সাত শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে আট শতাংশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ক্লাবে যোগ দিতে চায়। আর সেই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সরকার গত ৯ বছরে চার গুণেরও বিশাল পরিসরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। যাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথে নির্বাচনী বছরে অন্তত ৭ দশমিক আট শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধি অর্জন করা যায়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বাজেটের আকার এবং ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। সে হিসবেই বাজেটের সব ডকুমেন্ট ছাপার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। নতুন এই বাজেটকে অর্থমন্ত্রী ধারাবাহিকতা রক্ষার বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের তুষ্ট করার সব উপকরণই এবারের বাজেটে রয়েছে।
গ্রামের মানুষদের সুবিধা দিতে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে। দুস্থ মানুষকে চাল দিতে বাড়ানো হচ্ছে খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো অতিদরিদ্রদের জন্য পল্লী রেশনিং ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা আছে সরকারের শেষ বাজেটে। পাশাপাশি অতিদরিদ্র মানুষের সহায়তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতাও বেশ বাড়ানো হচ্ছে আসন্ন বাজেটে। প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন করে আরও প্রায় ১১ লাখ অতিদরিদ্র মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। এর ফলে এ কর্মসূচীর আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৮৬ লাখ। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে এসব উপকারভোগীর ভাতার পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার অর্ধেকেরও বেশি অনুন্নয়ন ব্যয়। প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারী কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় খরচ হবে ৬৬ হাজার ২২৪ কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে যে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, তা একযুগ আগের বাজেটের সমান। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এম সাইফুর রহমান ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ ওই অর্থবছরের বাজেটের সমান অর্থ খরচ করা হবে আগামী অর্থবছরে সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে। চলতি অর্থবছরে সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ আছে ৫৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের তুলনায় আগামী বাজেটে এ খাতে ১২ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। সরকারী খাতের বেতন-ভাতা বাবদ এভাবে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আপত্তি জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দেশের উন্নয়ন সহযোগীরা।
এছাড়া বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৪৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সুদ বাবাদ ব্যয়ই এখন বাজেটের সর্বোচ্চ একক খাত হিসেবে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ভর্তুকি ও প্রণোদনায় ৩১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং সেবা খাতে ব্যয় হবে ৩০ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে অনুন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে আগামী বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়ছে ৪৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আগামী বছরে সরকারের ১২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) ঘোষণা দেয়ার সম্ভাবনা আছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের এ বাজেটে চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এসব কারণেই সরকারী কর্মচারীদের বেতন ভাতায় বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে।
তবে অনুন্নয়ন ব্যয় বেড়ে গেলেও সরকার মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করবে। আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির হার ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বিবিএসের মাসওয়ারি হিসেবে দেখা যায়, গত মার্চে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এছাড়া নতুন অর্থবছরের উন্নয়ন কর্মসূচীতে ব্যয় করা হবে মোট একলাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) আকার হচ্ছে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। আর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে সাত হাজার ৮৬৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা খরচ করা হবে। মূল এডিপির মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে একলাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। গত ১০ মে শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় অনুমোদিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এডিপিতে ১৪৫২টি প্রকল্প রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্পের সংখ্যা ১২২৭টি, কারিগরি প্রকল্প ১১৭টি, জেডিসিএফের দুটি প্রকল্প রয়েছে। এর বাইরে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রকল্পের সংখ্যা ১০৫টি। এছাড়া আগামী এডিপিতে বরাদ্দহীনভাবে থাকছে ১ হাজার ৩৩৮টি প্রকল্প এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে রেকর্ড ৭৮টি প্রকল্প।
বিশাল ব্যয়ের এই বাজেটের বিপরীতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের আয়ের লক্ষ্য ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। আর নন-এনবিআর খাতে কর আদায়ের লক্ষ্য হচ্ছে ১১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এছাড়াও করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ১১২ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে বিশাল বাজেটে ঘাটতির আকারও বিশাল দাঁড়াচ্ছে। যার পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ওই হিসেবে আগামীতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। তবে মোট দেশজ উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কারণে আগামী বাজেটে ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।
বিশাল এই ঘাটতি সামাল দিতে সরকার নতুন বাজেটে দেশী- বিদেশী উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান গ্রহণ করবে। এরমধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ৫৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। এটি চলতি বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। এছাড়া বৈদেশিক উৎস থেকে ৩৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঋণ হিসেবে ৪২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা ও অনুদান ১০ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আবার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে সরকার ব্যয় করবে ১৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এছাড়া সরকার সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অবশ্য এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ১৬ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা কম। মাত্রাতিরিক্ত সুদ পরিশোধের চাপ থেকে বাঁচতে সরকার আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেবে। যে কারণে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার বেশি ঋণ নিচ্ছে। কারণ সঞ্চয়পত্র খাত থেকে বেশি ঋণ নিলে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিলে কম সুদ গুনতে হবে। সরকারের ব্যয়ও কমবে।
অবশ্য কয়েক বছর ধরে রাজস্ব ঘাটতির প্রেক্ষাপটে সরকার এবার নতুন বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সরকার বেশি ঋণ নিয়েছে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে। এতে পুরো আর্থিক খাতের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়েছে। এই চাপ কমাতেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বৈদেশিক সহায়তার ওপর। এছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মান বাড়ানো ও দারিদ্র্যের হার কমাতে প্রবৃদ্ধির হারও বাড়ানোর কৌশল থাকছে।
এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ঘোষণা থাকছে বাজেটে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি সহনশীল রাখা, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মুদ্রা বিনিময় হার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে রাখার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুসহ ফাস্ট ট্রাক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, রাজস্ব খাতের পরিকল্পিত সংস্কার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রফতানি বাড়ানোর প্রয়াস অব্যাহত ও জোরদার এবং সঠিক সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, এবারের বাজেট উচ্চাভিলাসী নয়। কারণ এবার বাজেট করার লক্ষমাত্রা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। সে পরিমাণে এখনও যেতে পারিনি। বাজেটের আকার না বাড়ালে আমরা জনগণকে সার্ভিস দেব কিভাবে? তাই আসন্ন বাজেটের আকার ধরা হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।