শক্তি প্রয়োগ করে ইসলামে দীক্ষিত করার বিধান

135

ডাঃ হাফেজ মাওলানা মোঃ সাইফুল্লাহ মানসুর

ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম সাম্যের ধর্ম। সকল মত ও পথের মানুষ যেখানে খুঁজে পায় শান্তির আবাস। যেখানে নেই কোন ভেদাভেদ, নেই ফকির-রাজার বিভেদ, নেই হিংসা ও ক্লেশ। ইসলাম শক্তি দিয়ে নয়, ইসলাম ভালোবাসা দিয়ে উড়াতে চায় শান্তির বাতাস। আবার ইসলাম সেখানে উদার নয় যেখানে আছে হিংসা বিদ্বেষ আর অশান্তির দাবানল। যেখানে আছে জুলুম আর জালিমশাহীর কোপানল। ইসলাম কঠোর হস্তে দমন করতে চায় জুলুমের কালো থাবা, থামাতে চায় অশান্তির কালো ছায়া। আসুন জেনে নিই ইসলাম কোথায় শক্তি প্রয়োগ করতে চায় আর কোথায় উদার হতে চায়। কাকে শক্ত হাতে দমন করে তার হুকুম মানতে বাধ্য করে আর কাকে তার নিজের হাতে ছাড়তে চায়।
ইসলাম কোন অমুসলিমকে শক্তি প্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করতে চায় না :
ধর্ম হলো যার যার মনের একটি বিশ্বাসের ব্যাপার। যার সাথে জড়িত রয়েছে ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি, আকাক্সক্ষা চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি। এটি জোর করে কাউকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আর ‘ইসলাম’ এমনই এই আকীদাগত এবং নৈতিক ও কর্মগত জীবনব্যবস্থা যা কারো ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। যেমন কাউকে ধরে এনে তার মাথায় জোর করে একটা বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়, এটা তেমন নয়৷ কারণ আল¬াহ তা’য়ালা হেদায়াত ও গোমরাহীকে, ইসলাম ও কুফরকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। বিধায় যিনি সজ্ঞানে জেনে শুনে-বুঝে সুজে ইসলামে দিক্ষিত হতে চায় তাকেই ইসলাম ঠাই দিতে চায়। আর আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করবেন, যার বক্ষ খুলে দিবেন, যার অন্তর উজ্জ্বল হবে, যার চক্ষু দৃিষ্টমান হবে সে আপনা আপনিই ইসলামে দীক্ষিত হতে পাগলপ্রায় হয়ে যাবে, তাকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করার প্রয়োজন হবে না। যেমন আল¬াহ তা’য়ালা বলেনঃ
﴿لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
অর্থ : দীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই৷ ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে৷ এখন যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে আল্ল¬াহর ওপর ঈমান আনে, সে এমন একটি মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা কখনো ছিন্ন হবার নয়৷ আর আল্ল¬াহ সবকিছু শোনেন ও জানেন৷
অন্যদিকে রাসূল (সঃ) ইরশাদ করেন : তোমরা অমুসলিমদেরকে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি করো না। নিশ্চয়ই বাতিল পথ হতে সৎপথের পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে গেছে। (হাদীস সহীহ। তাফসীর তাবারী -৫/৪০৮/৫৮১২, সুনান আবূ দাউদ-৩/৫৮/২৬৮২, সুনান নাসাঈ।
একদা আনসারদের বানূ সালিম ইবনু আওফ গোত্রের মধ্যে হুসাইন নামক একজন লোক ছিলেন। তিনি নিজে মুসলিম হলেও তার দু’টি ছেলে ছিলো খ্রিষ্টান। একবার তিনি রাসূলুল্ল¬াহ (সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) -এর নিকট আবেদন করেন যে, রাসূলুল্ল¬াহ (সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) যদি তাঁকে অনুমতি দেন তাহলে ছেলে দু’টিকে তিনি জোরপূর্বক মুসলিম বানাবেন। কেননা তারা স্বেচ্ছায় মুসলিম হতে চায় না। তখন لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ বাকারা-২৮৬ নং আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং এরূপ করতে তিনি নিষেধ করে দেন। (হাদীসটি য‘ঈফ। তাফসীর তাবারী -৫/৪০৯/৫৮১৭)
অতএব অমুসলিমদেরকে শক্তি দিয়ে নয় বরং তার কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শ পৌছে দেওয়া এবং উত্তম আদর্শ দিয়ে তাদের মন জয় করাই হলো হলো একজন মুসলিমের দায়িত্ব। যখন তার কাছে ইসলামে উত্তম আদর্শগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে, আল¬াহ যখন তার মনের সকল অসারতা দূর করে দিবেন তখন সে সকল বাধা ছিন্ন করে ইসলামের সুশিতল ছায়াই এমনিতেই আশ্রয় নিবে।
সমাজে যারা বিপর্যয় সৃষ্টি করে ইসলাম তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে চায়ঃ
উপরের আলোচনা দেখে কেউ যদি বলে এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, ইসলামে জিহাদের কোন প্রয়োজন নেই, শক্তি প্রয়োগের কোন দরকার নেই, যে যার মত চলবে, ইচ্ছে হলে ইসলাম মানবে, ইচ্ছে হলে তা মানবে না। আমি আমার স্বাধীন সত্বা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। আমার স্বাধীনতায় ইসলাম কোন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ভাল কিংবা খারাপ যে কাজই আমি করি না কেন ইসলাম সেখানে বাধা দিতে পারে না। তাহলে বলবো এ কথাটি হবে চরম ভ্রান্তমূলক বা অজ্ঞতাপ্রসূত কথা যা স্বাভাবিক জ্ঞান সম্পন্ন কোন লোক এ কথা বলতে পারে না। কারণ ইসলামে জিহাদ ও যুদ্ধের শিক্ষা মানুষকে ঈমান আনার ব্যাপারে বাধ্য করার জন্য দেয়া হয়নি বরং ইসলামে জিহাদ ও যুদ্ধ দেওয়া হয়েছে ফেৎনা-ফাসাদ দূর করার জন্য, সমাজকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাচাঁনোর জন্যে, জুলুমের হাত থেকে মজলুমকে বাঁচাবার জন্য এবং তাগুতি শক্তির দম্ভ চুরমার করে সেখানে শান্তি ও সাম্যের এক আবাসভূমি তৈরীর জন্য। একজন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করবে কি করবে না সেটা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর হতে পারে। সেখানে ইসলাম কোন শক্তি প্রয়োগে বিশ্বাসী নয় কিন্তু তাই বলে কোন দুষ্টু লোক সমাজে ফাসাদ সৃষ্টি করবে, মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধন করবে, মানুষের আব্রু সম্মানে আঘাত হানবে, ইসলামের স্বাভাবিক চলার গতিপথকে রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র লিপ্ত থাকবে, যারা দ্বীনকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাদের নির্মূল করতে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আর ইসলাম চুপ করে বসে থাকেবে সেটা কখোনই হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ইসলাম তাদের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করতেই জিহাদের নির্দেশ দেয়। যেমন আল¬াহ তায়ালা দীপ্ত কন্ঠে বলেনঃ
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَن يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم مِّنْ خِلَافٍ أَوْ يُنفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ۚ ذَٰلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
অর্থাৎ যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, তাদের শান্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলিবিদ্ধ করা হবে বা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে৷ অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে৷ দুনিয়ায় তাদের জন্য এ অপমান ও লাঞ্ছনা নির্ধারিত রয়েছে আর আখেরাতের রয়েছে তাদের জন্য এর চাইতেও বড় শান্তি। সূরা মায়েদা-৩৩।
কেননা ফেতনা-ফাসাদ আল্লাহ তা’য়ালা খুবই অপছন্দ করেন। অথচ কাফেররা ফাসাদের চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেন,
(كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِّلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ ۚ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا ۚ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ) তারা (কাফেররা) যতবার যুদ্ধের আগুন জ্বালায় ততবারই আল্লাহ তা’য়ালা তা নিভিয়ে দেন৷ তারা জমিনে ফাসাদ করে বেড়ায় , কিন্তু আল্লাহ তাআলা ফাসাদ সৃষ্টিকারীদেরকে কখনো পছন্দ করেন না”। [সূরা আল-মায়িদাহ ৬৪]
এজন্য আল্লাহ ্ তা’আলা জিহাদের মাধ্যমে এসব দুষ্টু লোকের সৃষ্ট যাবতীয় অনাচার দূর করার জন্য মু’মিনদের নির্দেশ দেন। ইসলাম জিহাদ এবং যুদ্ধের অনুমতি দিলেও জিহাদের ময়দানে স্ত্রীলোক, শিশু, বৃদ্ধ এবং অচল ব্যক্তিদের হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। ইসলামের এ মহান কর্মপদ্ধতিতে প্রমান করে যে, ইসলাম জিহাদ ও যুদ্ধের দ্বারা মানুষকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করে না, বরং এর দ্বারা দুনিয়া থেকে অন্যায় অত্যাচার দূর করে ন্যায়-ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
**ইসলাম দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে চায় :
কোন কোন নামধারী মুসলিম ইসলামের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তারা ইচ্ছা হলে তা পালন করে আবার ইচ্ছা হলে তা পরিহার করে। তারা মনে করে ইসলামের হুকুম-আহকাম পালন করার ক্ষেত্রে কোন “জোর-জবরদস্তি নেই” তাই তারা নিজেদের ইচ্ছামত বল্গাহীন জীবন-যাপন করতে চায়। তাদেরকে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে যে, ইসলাম বলেছে যে, শুধুমাত্র যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদেরকে জোর করে ইসলামে আনা যাবে না। কিন্তু যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করে তারা ইসলামের প্রতিটি আইন ও যাবতীয় হুকুম-আহকাম বিশেষ করে আল্লাহর ফরজ বিধানগুলি মানতে তারা বাধ্য। সেখানে শুধু জোর-যবরদস্তিই নয় বরং শরীআত না মানার শান্তি ও ইসলামে নির্ধারিত রয়েছে। যেমন নামাজের ব্যপারে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আহলে সুন্নাত বিদ্বানগণের মধ্যে ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, এবং প্রাথমিক ও পরবর্তী যুগের প্রায় সকল ওলামায়ে-কেরামগণ এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, ঐ ব্যক্তি ‘ফাসিক্ব’ এবং তাকে তওবা করতে হবে। যদি সে তওবা করে নামাজ আদায় শুরু না করে, তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। আর ইমাম আবু হানীফা (রহ.) মতে, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং নামাজ আদায় না করা পর্যন্ত জেলখানায় আবদ্ধ রাখতে হবে। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেন, ঐ ব্যক্তিকে নামাজের জন্য ডাকার পরেও যদি সে ইনকার করে ও বলে যে ‘আমি নামাজ আদায় করব না’ এবং এইভাবে ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায় তখন তাকে কঠোর শাস্তি ওয়াজিব। অবশ্যই এরূপ শাস্তিদানের দায়িত্ব হ’ল ইসলামী সরকারের। শুধু তাই নয় প্রয়োজনে তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদেরকে দ্বীনের যাবতীয় আইন মানতে বাধ্য করানো অন্যান্য মুসলিমদের উপর ওয়াজিব। (তাফসীরে আবু বকর যাকারীয়া) যেমনটি সিদ্দিকে আকবর আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহুর খেলাফত কালে যাকাত প্রদানে অনীহাকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তার দ্বীন সঠিকভাবে বুঝার তৌফিক দান করুন এবং সকল ধরনের ফেতনা-ফাসাদ হতে দূরে থাকার পথকে সহজ করে দিন আমিন।