কুয়েতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ॥ কমলগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম

57

পিন্টু দেবনাথ, কমলগঞ্জ থেকে :
কুয়েতের সালমিয়া শহরের একটি আবাসিক ভবনের তিন তলার এসির কমপ্রেসার বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে একই Kamalgonj Pic Kandigoan- 2পরিবারের শিশুসহ পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫ টায় কুয়েত শহরের সালমিয়াত একটি আবাসিক ভবনের তিন তলায় আগুন লেগে যায়। এ সময় ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে সন্তানদের নিয়ে নিচে নামতে গিয়ে ৪ তলার বাসিন্দা বাংলাদেশী জুনেদ আহমদের স্ত্রী রোকেয়া বেগমসহ  দুই ছেলে ও দুই মেয়ে শ^াসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে। ঘটনার সময় গৃহকর্তা জুনেদ আহমদ বাসার বাইরে থাকায় বেঁচে গেছেন। সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় খবরটি গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে পৌছলে শুরু হয় শোকের মাতম। নিহতদের বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামে।
গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কান্দিগাঁও গ্রামের মোহাম্মদ জুনাইদ স্বপরিবারে কুয়েতের হাওয়ালি জেলার সালমিয়া এলাকায় ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। গত সোমবার (১৬ অক্টোবর) দুপুর ২টার সময় (বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টা) তিন তলার এসির কমপ্রেসার বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ সময় ভয়ে জুনাইদ আহমেদর স্ত্রী রোকেয়া বেগম সন্তানদের নিয়ে ৪ তলা থেকে নিচে নামতে গিয়ে ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ভবনের ভিতরই মারা যান। নিহতরা হলেন-জুরাইদ আহমদ এর স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৩২), বড় মেয়ে জামিলা আহমদ (১৫), বড় ছেলে ইমাদ আহমদ (১২), দ্বিতীয় মেয়ে নাবিলা আহমদ (৯) ও ছোট ছেলে ফাহাদ আহমদ (৫)। অগ্নিকান্ডের সময় জুনাইদ আহমেদ অফিসে থাকায় ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। ঘটনার খবর পেয়ে জুনাইদ আহমদ ভবনে ফিরে একসাথে স্ত্রী সন্তানদের মৃতদেহ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পরে তিনি আবার বাসায় ফিরে আসেন। অগ্নিকান্ডে নিহতদের মৃতদেহ কুয়েতের মোবারক আল কবির হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় কুয়েত জুড়ে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা গভীরভাবে শোকাহত। কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্টদূত ও কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও শোকাহত জুনাইদ আহমেদকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।
এদিকে মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) সকালে সরেজমিন কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামে গেলে কুয়েত প্রবাসী মোহাম্মদ জুনাইদের প্রতিবেশি বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বাড়িতে জুনেদের বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই। মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন আরো জানান, জুনাইদ আহমদ স্বপরিবারে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কুয়েতে বসবাস করছেন। নিহতের গ্রামের বাড়ি কমলগঞ্জের কান্দিগাঁও গ্রামে একমাত্র বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ নেই। তবে এ দুর্ঘটনার খবর সোমবার রাতে শোনে কমলগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে আসে। মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন আরও জানান, জুনাইদ মিয়ার অপর দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই জুবের মিয়া স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য ভাই স্বপরিবারে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বসবাস করছেন। সব শেষ গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জুনাইদ স্বপরিবারে দেশে এসে আবার চলতি বছরের ২ ফেব্র“য়ারী কুয়েত ফিরে যান। নিহতের গ্রামের বাড়ি কমলগঞ্জের কান্দিগাঁও গ্রামে একমাত্র বৃদ্ধা মা মরিয়ম বিবি (৭০)ছাড়া আর কেউ নেই। ঘটনার খবর পেয়ে সোমবার রাতেই বড় বোন মুসলিমা বেগম (৪৮) মায়ের পাশে এসে অবস্থান করছেন। নিহত গৃহবধূ রোকেয়া বেগমের ভাতিজা খালেদ আহমদ (২০) এ প্রতিনিধি জানান, দুর্ঘটনার ৩০ মিনিট আগেও তিনি ফোন করে বাড়ি ঘরের খোঁজ খবর নেন।
কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: আব্দুল হান্নান এ দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, গ্রামের বাড়িতে জুনাইদের বৃদ্ধা মা ছাড়াও আত্মীয় স্বজন রয়েছেন। এখন তার মাও স্বজনদের মাঝে শোকের মাতম চলছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, সোমবার সকালে শোকার্ত জুনাইদ মিয়ার পরিবারকে সমবেদনা জানাতে কান্দিগাঁও গ্রামের বাড়িতে যান।
বিভিন্ন অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুয়েত প্রবাসী কমলগঞ্জের বাসিন্দা একই পরিবারের পাঁচ জনের মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মঙ্গলবার ভোর থেকে কান্দিগাঁও গ্রামে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। শুরু হয় শোকের মাতম। ঘটনার খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকালে কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমান, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহামম্মদ মাহমুদুল হকসহ জনপ্রতিনিধিসহ সামাজিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বাড়িতে এসে সমবেদনা জানান।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এক সাথে মাসহ বাকী ৪ সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে। সমবেদনা জানাতে এসি তিনি নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
নাবিলা জামিলা নামে মেধাবী দুই বোন ছিলো যারা দেড় যুগের কম সময় ধরে পৃথিবীতে বাস করছিলো। ইমাদ ও ফাহাদ নামে তাদের ফুটফুটে দু’টো ছোট ভাইও ছিলো। সবমিলে চার ভাইবোন দারুণ হেসেখেলে বাড়ছিলো। তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে। মা বাবা তাদের নিয়ে কুয়েতে বাস করতেন। অক্টোবরের ষোলো তারিখ এক দুর্ঘটনায় তাদের মা রোকেয়া বেগম তাদেরকে নিয়ে চলে গেছেন ঝলমলে ধ্র“বতারার দেশে। পৃথিবীতে তারা এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের পিতা জুনাইদ মিয়া বেচেঁ আছেন এখনও। তিনি পারবেনতো তাদের ছাড়া বেঁচে থাকতে!