মজুদদারীর প্রভাব ও প্রতিকার

111

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

সা মাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে। প্রয়োজনের তাগিদে একে অন্যের সাথে পারস্পরিক লেনদেন এবং জিনিসপত্রের আদান-প্রদান করে থাকে। প্রাত্যহিক লেনদেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ব্যবহারিক জীবনে ব্যবসায়-বাণিজ্যে পণ্য ও মূল্যের বিনিময় হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পণ্য ও মূল্যে যৌক্তিক বিনিময় আদান প্রদান হওয়া কাম্য হওয়া সত্ত্বেও যখন বিক্রেতা অতি মুনাফার লোভে চড়ামূল্যে বিক্রয় করার জন্য পণ্য সামগ্রী কুক্ষিগত করে, তখন একে বলে মজুদদারি। এর ফলে পণ্যের মূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ইসলাম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। মাওজুদ ও মজুদ শব্দ থেকে মজুদদারি শব্দটি এসেছে। মাওজুদ অর্থ হচ্ছে, সঞ্চিত, জমা, হাজির, উপস্থাপিত ইত্যাদি। আর মজুদদারি অর্থ হচ্ছে, দ্রব্যাদি অন্যায়ভাবে মজুদ বা জমা রাখা। যে ব্যবসায়ী অন্যায়ভাবে দ্রব্যাদি মজুদ করে রাখে তাকে মজুদদার বলা হয়। মজুদদারি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার উপর নির্ভর করে এর ধরনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কয়েকটি ধরন উপস্থাপিত হলো- আংশিক মজুদদারি: অল্প সংখ্যক উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা কোন একটি নির্দিষ্ট পণ্য মজুদ করে রাখবে। আর তাদের এই মজুদের কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পাবে। পারস্পরিক মজুদদারি: বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী নির্দিষ্ট একটি পণ্য আটকে রাখবে। আর এই পণ্যের ক্রেতা থাকবে একজন। ক্রেতাও এই পণ্যের ক্রয় আটকে রাখবে। এখানে পণ্যের মূল্য এই ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পারস্পরিক দরকষাকষির উপর নির্ভরশীল থাকবে।
কোন ব্যক্তি একটি পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় আটকে রাখবে। আর এই পণ্যের বিকল্প দেশের ভিতরে বা বাইরে কোথাও পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রীয় মজুদদারি: কোন রাষ্ট্র কোন একটি পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করবে। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি বা পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কখনো পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে দিবে বা সরবরাহ যাতে ব্যাহত হয়, সে জন্য বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করবে। মজুদদারা হিংস্র মনোভাব পোষণকারী হয়ে থাকে। এরা সব সময় উচ্চ মূল্যের প্রত্যাশায় থাকে। এরা যদি কখনো শুনতে পায় যে, পণ্যমূল্য কমে গেছে, তাহলে বিষণœ হয়ে পড়ে। আর যদি শুনতে পায় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তাহলে উল্লসিত হয়। এ জন্য অন্য আরেক হাদীসে এসেছে, পণ্য মজুদকারী ব্যক্তির উপর সমস্ত সৃষ্টিকুলের অভিসম্পাত বর্ষিত হয়।
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে। অর্থব্যবস্থার ভিন্নতার প্রেক্ষিতে মজুদদারিতেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে রাখে। আবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি পণ্য মজুদ করে থাকে। তবে দুই অর্থব্যবস্থাতেই মজুদদারির পরিণতি ভয়াবহ। এ ছাড়াও আরো কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।  যেমন- ব্যক্তি ও রাষ্ট্রসমূহের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব নষ্ট হয়ে যায়। কেননা প্রতিযোগিতা না থাকলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হয় না এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় না। ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে যাওয়ার আশংকায় আমদানীকৃত পণ্য সামগ্রী ধ্বংস করে দেয়া হয়। কেননা আমদানীকৃত পণ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে দ্রব্যমূল্য কমে যায়। মুনাফা স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা আগুনে পুড়িয়ে বা সমুদ্রে ফেলে পণ্য ধ্বংস করে। ফলে খাদ্যের মারাত্মক সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মজুদদারি সমাজে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। মানুষের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক সময় সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।  সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। ফলে আইন শৃংখলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। আর অর্থনীতিতে চরম মন্দা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে।
ঊধংঃ ইবহমধষ অপঃ এর আওতায় অত্যাবশকীয় কিছু পণ্যের সরবরাহ, বিতরণ এবং মজুদ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৩ সালে ঞযব ঊংংবহঃরধষ অৎঃরপষবং (চৎরপব ঈড়হঃৎড়ষ ধহফ অহঃর-ঐড়ধৎফরহম) অপঃ, ১৯৫৩ শিরোনামে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয। এই আইনের অধীনে অত্যাবশকীয় পণ্য বলতে ঞযব ঈড়হঃৎড়ষ ড়ভ ঊংংবহঃরধষ ঈড়সসড়ফরঃরবং অপঃ, ১৯৫৬ এর ধারা ২ এ উল্লেখিত পণ্যসমূহকে বুঝানো হয়েছে। ধারা ৮ অনুযায়ী কোন ব্যবসায়ী সরকার কর্তৃক দেয় পূর্ব কর্তৃত্ব ছাড়া কোন ব্যক্তির কাছে কোন অত্যাবশকীয় পণ্যের বিক্রি আটকে রাখতে পারবে না বা বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারবে না।
ঞযব ঊংংবহঃরধষ অৎঃরপষবং (চৎরপব ঈড়হঃৎড়ষ ধহফ অহঃর-ঐড়ধৎফরহম) অপঃ, ১৯৫৩ এর ধারা ৩ অনুযায়ী সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সময়ে সময়ে খুচরা, পাইকারি বা অন্য কোন ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থাভেদে বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। জনগণের সুবিধার্থে সরকার ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যের নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ প্রদান করতে পারবে। ব্যবসায়ীগণ সুবিধাজনক জায়গায় বা নিজেদের দোকান ও গুদামের সামনে পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের তারিখ ও মেয়াদও সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে। “ঞযব ঊংংবহঃরধষ অৎঃরপষবং (চৎরপব ঈড়হঃৎড়ষ ধহফ অহঃর-ঐড়ধৎফরহম) অপঃ, ১৯৫৩” যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করে তবে সে ঞযব ঐড়ধৎফরহম ধহফ ইষধপশ গধৎশবঃ অপঃ, ১৯৪৮ এর ৩নং ধারার অধীনে শাস্তি যোগ্য অপরাধী বিবেচিত হবে।
ঞযব ঈড়হঃৎড়ষ ড়ভ ঊংংবহঃরধষ ঈড়সসড়ফরঃরবং অপঃ, ১৯৫৬ অনুযায়ী সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পণ্যকে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অতি জরুরী বলে ঘোষণা করতে পারে এবং অন্য যে কোন পণ্যের উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ, ব্যবহার এবং ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ আইনের আওতায় কিছু পণ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রদান এবং মূল্য নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। “ ঞযব ঈড়হঃৎড়ষ ড়ভ ঊংংবহঃরধষ ঈড়সসড়ফরঃরবং অপঃ, ১৯৫৬ এর ৩নং ধারা” ধারা ৬ অনুযায়ী উক্ত আইন ভঙ্গকারীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
আলিমগণের সর্বসম্মত মত হলো, যদি সর্বসাধারণের উপর দুর্ভিক্ষের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে বা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর ঘাটতি দেখা দেয় এবং সর্বসাধারণের মাঝে হাহাকার লেগে যায়, তখন সরকার ন্যায্য মূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করতে মজুদদারদের বাধ্য করতে পারবে। বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে। অতি মুনাফার লোভে খাদ্য সামগ্রী আটক রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপরাধে সরকার ব্যবসায়ীকে শাস্তিও প্রদান করতে পারবে। ইমাম ইবনে আবেদীন র. তাঁর রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থে বলেন, মজুদদারির কারণে দেশে খাদ্য শস্যের অভাবে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সরকার মজুদদার শ্রেণিকে তাদের প্রয়োজনীয় খোরাকী রেখে অবশিষ্ট সমস্ত সম্পদ ন্যায্য মূল্যে বাজারজাত করতে নির্দেশ প্রদান করবে। সরকারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে দেশের সকল হাট-বাজারে সুলভ মূল্যে তাদের গুদামজাত খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করবে। এমনকি অভাবের কারণে জনগণ নগদ মূল্য পরিশোধ করতে অক্ষম হলে তাদের সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত মেয়াদ ধার্য করে বাকীতে খাদ্য হস্তান্তর করবে। পরে তাদের হাতে খাদ্য শস্য আসলে সরকার তাদের নিকট থেকে তা উসূল করে দাতার নিকট পৌঁছি দিবে।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সহজলভ্য ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা সরকারের দায়িত্ব এবং ভোক্তা শ্রেণীর অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মজুদদার লুটেরাদের হাতে কুক্ষিগত। অতি মুনাফাখোর অসাধু একদল ব্যবসায়ীর যাঁতাকলে আজ সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত। অসাধু ব্যবসায়ী শ্রেণি সিন্ডিকেট করে পণ্য গুদামজাত করে রাখে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে পণ্যের মূল্য নিজেদের ইচ্ছাকৃত নির্ধারণ করে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ভোক্তা সাধারণ যথেষ্ট মনে করেন না। কখনো অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ী শ্রেণীর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশ থাকার কথাও গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা যায়। কর্তৃপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে দফায় দফায় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আর ক্রেতা সাধারণ আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের কারণে হয়ে পড়ে দিশেহারা। বিশেষত রমযান ও ধর্মীয় উৎসবগুলোতে বাজার ব্যবস্থাপনায় শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করে। তখন কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য মজুদ করে রাখে। এতে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়তে থাকে। ভোক্তা শ্রেণী প্রয়োজনের তাগিতে চড়ামূল্যে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য হয়। ফলে এ সুযোগে অতি মুনাফাখোর একদল অসাধু ব্যবসায়ী সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। আর সাধারণ মানুষ চড়া মূল্যে পণ্য ক্রয় করে নিঃস্ব থেকে আরো নিঃস্বতর হয়। এ সমস্যা নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হয় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বহু সচিত্র প্রতিবেদন ও প্রচার হয়। বিভিন্ন সময়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে এ সমস্যা নিরসনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং সুপারিশমালা গ্রহণ করা হয়। তখন সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মজুদদারি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের নানা কথা বলে থাকেন এবং ব্যবসায়ীরা বহু প্রতিশ্র“তি দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে এ সমস্যার প্রতিকার সামান্যই পরিলক্ষিত হয়।
কৃত্রিম সংকট তৈরী করে বেশি মুনাফা অর্জন করা বা দুর্ভিক্ষের অপেক্ষায় থেকে পণ্য চড়া মূল্যে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে পণ্য সামগ্রী মজুদ রাখা একেবারেই নিষিদ্ধ। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় অল্প দিনের জন্য মজুদ করা হলে তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। আর যদি বেশি দিন মজুদ করে রাখা হয় তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কোন কোন আলিমের মতে, সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে চল্লিশ দিন। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত্র খাদ্যশষ্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে সম্পর্কহীন হয়ে গেল এবং আল্লাহও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন”। আবার কেউ বলেছেন, এক মাস। কেননা এক মাসের নিচে হলে তা কম হিসেবে ধরা হয়। আর এক মাসের বেশি হলে তা সর্বোচ্চ হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু চল্লিশ দিনের অধিক রাখলে দুনিয়াতে তাকে শাস্তি দিতে হবে। মোটকথা শরীয়তের দৃষ্টিতে খাদ্য সামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আটক রাখা সমীচীন নয়।
মানুষ ও চতুষ্পদ জীব-জন্তুর খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রচুর পরিমাণে কিনে মজুদ করে চড়া মূল্যের অপেক্ষায় বাজারজাত করা থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্য মজুদ করে রাখার অনুমতি আছে। যেমন- নিজের জমির উৎপাদিত ফসল মজুদ করে রাখা যাবে। অনুরূপভাবে পরিবারের বাৎসরিক ব্যয়ভার বহনের প্রয়োজনীয় পরিমাণ পণ্য মজুদ রাখা যাবে। কেননা উমর রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বনী নযীরের খেজুর গাছ বিক্রি করে দিয়েছিলেন এবং তাদের এক বছরের খাদ্য সামগ্রী তার পরিবারের জন্য মজুদ করে রেখে দিয়েছিলেন”। মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া অন্য জিনিসপত্র যা মৌলিক প্রয়োজনে পড়ে না, তা মজুদ করা যাবে। নিজ শহর থেকে নয় বরং দূরবর্তী শহর- যেখান থেকে সাধারণত সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসে না, সেখান থেকে আমদানী করে মজুদ করে রাখা যাবে। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়াতে অথবা অতিরিক্ত মৌসুমী উৎপাদন অন্য মৌসুমে সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে সরকার প্রয়োজনীয় পরিমাণ পণ্য সামগ্রী মজুদ করতে পারবে। তবে যে কোন অবস্থায় যদি মানুষ বা পশুর প্রয়োজনে মজুদকৃত পণ্য বিক্রির প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে পণ্য সামগ্রী আটকে না রেখে প্রয়োজন ও মানবিক দিক বিবেচনা করে সুলভ মূল্যে বিক্রি করে দেয়া কর্তব্য।
মজুদদারির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যে অস্থিতিশীল ও অরাজকতাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা অর্থব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আর সামাজিক কর্মকান্ডে যে নৈরাজ্যকর ও বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা সমাজ ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে শাশ্বত ও যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। মজুদদারিকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এ অবস্থা নিরসনে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন: সরকার মজুদদারির কুপ্রভাব সর্বসাধারণের সামলে তুলে ধরবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি-নিষেধগুলো প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মজুদদারদেরকে শরয়ী নির্দেশনা পালনে পদক্ষেপ নিবে এবং ভোক্তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে। দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সরকার মজুদদারদেরকে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মজুদকৃত পণ্য সুলভ মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। মুজদদার শ্রেণী যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে জনসাধারণের দু:খ-দুর্দশা লাঘবে এবং তাদের স্বার্থ ন্যায়সঙ্গতভাবে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকার মজুদকৃত পণ্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে তা ন্যায্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় সে সকল পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যা মজুদদারির কারণে দু®প্রাপ্য এবং দেশের অভ্যন্তরে সব পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাবে। সরকার অন্যান্য দেশের সাথে পণ্য বিনিময় করবে বা তাদেরকে ব্যবসায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষত দু®প্রাপ্য পণ্য সামগ্রী বাণিজ্যিকীকরণে তাদের উৎসাহিত করবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করবে। যদি মুজদদারির কারণে পণ্য সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যায় এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিবে। আর মজুদদার শ্রেণিকে পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। কিন্তু বাজার যখন স্থিতিশীল হয়ে যাবে তখন ক্রেতা-বিক্রেতাকে স্বাধীনতা দেয়া হবে, যাতে তাদের চাহিদার আলোকে পণ্য মূল্য নির্ধারিত হয়। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করবে। মনিটরিং সেলের অধীনে নিজস্ব জনবল দিয়ে প্রতিনিয়ত বাজার পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি পরিদর্শকদলের নিকট কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হয় তাহলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খাদ্য নিজস্ব উদ্যোগে আমদানীর জন্য সরকার একটি বোর্ড গঠন করতে পারে। এ বোর্ডের মাধ্যমে পণ্য আমদানী করবে বা যারা পণ্য আমদানী করবে এ বোর্ড তাদের মনিটরিং করবে। এতে আমদানীকারকরা বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রির সুযোগ নিতে পারবে না। এ সকল পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকর ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করবে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার অধিকার সুনিশ্চিত হবে।
ইসলাম মানব জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডেও কল্যাণকর নীতি-আদর্শ উপহার দিয়েছে। এ নীতির অন্যতম দিক হলো- মজুদদারি, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী ও যে কোন প্রতারণামূলক ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিষিদ্ধকরণ। ইসলাম অতি মুনাফার লোভে প্রতারণা করে ও অপকৌশল অবলম্বন করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আটক রাখাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আধুনিক কালেও যেখানে পৃথিবীর নানা স্থানে মজুদদারির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনসাধারণ বিপর্যপ্ত, সেখানে ইসলাম বহুকাল পূর্বেই এর আইনগত বিধান বর্ণনা করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করেছে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় যদি ব্যবস্থায়-বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা হয় তাহলে শুধু মজুদদারির অপতৎপরতাই নয় ব্যবসায়-বাণিজ্যে কোন ধরণের নৈরাজ্য থাকবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।