কাজির বাজার ডেস্ক
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও এ কে এম শহীদুল হককে গত ৩ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। শহীদুল হককে উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সেনা হেফাজতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তিনি সেনা হেফাজতে থাকাবস্থায় আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই সরকার আমলে আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সরকার পতনের পরদিন তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। অন্যদিকে শহীদুল হক ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যান। সাবেক দুই আইজিপি রিমান্ডে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন তিনি পরিস্থিতির শিকার। শহীদুল দাবি করেন তাকে এসবের মধ্যে জড়ানো হচ্ছে। গ্রেফতার সাবেক দুই আইজিপি রিমান্ডে কী তথ্য দিয়েছেন জানতে চাইলে ডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি পরিস্থিতির শিকার। আমি গুলি চালাতে চাইনি, যা করেছি সবই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করেছি। তার নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়েছে। ঘটনার সময় যেহেতু আমি আইজিপি ছিলাম, তাই আমার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এ কারণে আমি নিয়তি মেনে নিয়েছি, যা হওয়ার তাই হবে-এটা মাথায় রেখেই আমি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিই। পরে সেনা হেফাজত থেকে আমাকে পুলিশে দেওয়া হয়।’
ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, আমি অনেক আগেই অবসর নিয়েছি। এরপর থেকেই আমি নিষ্ক্রিয়। আমাকে কেন এসবের মধ্যে জড়ানো হচ্ছে? ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘একেএম শহীদুল হক বিভিন্ন সময় ঝাঁজালো মন্তব্য করেছেন। মূলত এসব বিষয়ে তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’
এদিকে শেখ হাসিনা স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের ৫ নেতা দায়ী। এরা হলেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
পাঁচ আগস্টের পর গ্রেফতার শেষে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে নেতারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) এসব তথ্য দেন। গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের। বিভিন্ন মামলায় ডিবি হেফাজতে রিমান্ড শেষে ইতোমধ্যেই তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র রোববার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেফতারদের অনেকেই বলেছেন, তারা শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বারবার সতর্ক করেছেন। বলেছেন, যা হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে না। কিন্তু তারা কোনো উপদেশই শোনেননি। শেখ হাসিনা ছিলেন একরোখা। ডিবি জানায়, জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে অন্যরা যেসব অভিযোগ তুলেছেন সেসব ডিবি হেফাজতেই অস্বীকার করেছেন পলক। পলক ডিবিকে জানিয়েছে, অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনাসহ অন্য নেতারা তাকে পদত্যাগ করতে দেননি। আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক তাকে গালিগালাজ করেছেন। বলেছেন, এই মুহ‚র্তে মন্ত্রিসভার কেউ পদত্যাগ করলে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। ওবায়দুল কাদের তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। শেখ হাসিনার সামনে পলককে অপমান করা হলেও তিনি (হাসিনা) কোনো ভ‚মিকা নেননি। উল্টো তার অবস্থান ছিল নানক-কাদেরদের পক্ষেই।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ডিবিকে জানিয়েছেন, ৫-৬ জন নেতার জন্য দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। আর এ পরিণতির জন্য শেখ হাসিনা নিজেই দায়ী। সালমান আরও বলেছেন, ‘আমি যেহেতু ব্যবসায়ী, তাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমার বেশি বৈঠক হতো। ওইসব বৈঠক থেকে দেশের অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে তারা চাপ দিত। আমি ওই চাপের কথা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করতাম। কিন্তু তিনি পাত্তা দিতেন না। রুদ্ধদ্বার বৈঠকগুলোতে আমাকে রাখতেন না।’ কারফিউ ঘোষণার দিন ওবায়দুল কাদেরের ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’-এর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আইনগতভাবে এটা বলার সুযোগ নেই। তিনি কেন এ ধরনের কথা বলেছেন তার ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিতে পারবেন। যুক্তরাষ্ট্র কানেকশনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ডিবিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমার কোনো বিশেষ কানেকশন ছিল না। তারা আমাদের দেশে অনেক বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু টাকা নিতে পারছিল না। এ কারণে তারা মাঝেমধ্যে আমাকে নক করত।’
যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন কেন বারবার এসে আপনার সঙ্গে বৈঠক করত-জানতে চাইলে সালমান এফ রহমান ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলেন, বৈঠকগুলো ছিল মূলত অর্থনৈতিক বিষয়ে। ডলার সংকটসহ নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দিতে পারছিলাম না। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আমি কোনো কথা বলতাম না।’ অর্থপাচারের বিষয়ে সালমান এফ রহমান কী বলেছেন-জানতে চাইলে ডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেন, সালমান কিছুটা দায় স্বীকার করলেও পুরো দায় চাপিয়েছেন শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্য ও মন্ত্রিসভার কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সবকিছুই জানতেন বলে রিমান্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামি জানিয়েছেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে করে বলেন, ‘সবকিছুর জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য দায়ী। আমি তাকে মাঝেমধ্যেই আইনগত বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতাম। কিন্তু তিনি এক কান দিয়ে শুনতেন, অন্য কান দিয়ে বের করে দিতেন। তিনি সব সময় ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল।’