কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ সেই ভয়াল কালরাত। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। একাত্তরের অগ্নিঝরা এ দিন গত রাতে ঘুমন্ত বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে পাক হানাদাররা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। আর বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে ইতিহাসের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।
তখনো কেউ জানে না কি ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালির জীবনে। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে তখন ঘুমিয়েও পড়েছে। অকস্মাৎ যেন নরকের সব কয়টি দরজা খুলে গেল। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই করে নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তানের সৈন্য ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো শহরজুড়ে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো আধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের মাধ্যমে পাক জল্লাদ বাহিনী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। শুরু হলো বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। হতচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। মানুষের কান্না ও আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠে শহরের আকাশ। মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হলো লাশের শহরে। ঢাকা শহরের রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে তারা বাঙালি নিধন শুরু করে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল অর্ধ লক্ষাধিক বাঙালিকে। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক।
শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস হত্যাকান্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। পাক হানাদাররা সেই রাতে অগ্নিসংযোগ, মর্টার শেল ছুড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেস ক্লাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও জান্তার কালো থাবা থেকে রক্ষা পাননি। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তাদের এই সশস্ত্র অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল একটিই। আর তা হলো বাঙালির মুক্তির আকাক্সক্ষাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করা।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। তারা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গোপনে গোপনে সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিকামী বাঙালি তখন স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেলিত। আলোচনার নামে শাসকগোষ্ঠীর সময়ক্ষেপণকে বাঙালিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার একটি দিক-নির্দেশনামূলক রূপরেখা পেশ করেন। যা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মূলমন্ত্র।
এদিকে সামরিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য ও গোলাবারুদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়। বিষয়টি বাঙালিদের অজানা ছিল না। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তারা। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন। ২৫ মার্চ রাত সোয়া ১টার দিকে এক দল সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধু বীরের মতো দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। এ সময় বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাতের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল। অবশ্য গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিয়ারের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। আর এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছে। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের তৎকালীন শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।
এবার জাতির জীবনে ভয়াল ২৫ মার্চ কালরাত এসেছে এক অন্যরকম আবহে। একাত্তরে যেসব এ দেশি রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ওই রাতে গণহত্যা চালাতে পাক হানাদারদের সহযোগিতা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল, লুটপাট-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ইতোমধ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। বাকিদেরও বিচারের রায়ের অপেক্ষায় দেশের মানুষ। দেশবাসীর প্রত্যাশা আর বিলম্ব নয়, দ্রুত সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কের হাত থেকে মুক্তি দেয়া হোক।
কর্মসূচি : জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে ২৫ মার্চের সেই কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার বীর বাঙালিদের। রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃৃতিক সংগঠন ‘কালরাত্রি’ স্মরণে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিনভর থাকছে আলোচনা সভা, শোকসভা ও রাতে মোমবাতি প্রজ্বলন। শোকাবহ জাতি ঘৃণা ও ধিক্কার জানাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশি দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসদের।