কাজিরবাজার ডেস্ক :
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় এখন পর্যন্ত ৬০৮ মামলায় ৩ হাজার ৩শ’ ৬৪ জন আসামীর নাম এসে জমেছে। বর্তমানে সংস্থায় তদন্তাধীন আছে ৪৩ জন আসামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ২১টি মামলা।
এছাড়াও তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হয়ে ১৭ মামলায় ১৮ যুদ্ধাপরাধীর মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। একজন অভিযুক্ত বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে মারা যাওয়ার কারণে তার মামলার নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
তদন্ত শেষে দুই ট্রাইব্যুনালে এখন বিচার চলছে পাঁচ মামলায় আরও নয়জনের বিরুদ্ধে। এছাড়া একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার শুরুর অপেক্ষায় আছে।
আর তদন্ত সংস্থায় তদন্তাধীন আছে ২১টি মামলা। এসব মামলার ৫৬ জন আসামীর মধ্যে কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকিদের বিষয়ে তদন্ত কিছুটা অগ্রসর হলেই গ্রেফতারের আবেদন জানানো হবে বলে জানান তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে তদন্ত সংস্থায় মামলা আসা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় ৬০৮টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, এসব মামলায় আসামীদের অপরাধের গভীরতা পর্যালোচনা করে পর্যায়ক্রমে তদন্ত কাজ করছেন তদন্ত সংস্থা।
সানাউল হক বলেন, এখন পর্যন্ত সারাদেশ থেকে আসা মামলার সংখ্যায় বিভাগীয়ভাবে খুলনা বিভাগ এগিয়ে আছে। খুলনা বিভাগে ১৪৮২ জনকে আসামি করে ১৮৮টি মামলা হয়েছে। ঢাকা বিভাগে মোট ১১৯টি মামলায় আসামী হয়েছেন ৫১৪ জন।
চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৮টি মামলা দায়ের হয়েছে, এতে আসামি রয়েছেন ৩১৬ জন। রাজশাহী বিভাগে ৬৭টি মামলায় ৩৭৮ জন আসামী। সিলেট বিভাগে ৫৪টি মামলায় ২২৬ জন আসামি, বরিশাল বিভাগে ৬১টি মামলায় ২৯৯ জন আসামি রয়েছেন এবং রংপুর বিভাগে ১৪৯ জনকে আসামি করে এ পর্যন্ত ৩১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মামলাগুলোর মধ্যে বর্তমানে ২১টি যুদ্ধাপরাধ মামলার ৪৩ জন আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
তদন্তাধীন মামলাগুলোর মধ্যে জামালপুর জেলার আটজন একটি মামলার আসামি। তাদের সবার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর জামায়াতের সাবেক আমির এডভোকেট শামসুল আলম ও সাবেক জামায়াত নেতা সিংহজানি স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক এস এম ইউসুফ আলী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। অন্য ছয়জন হচ্ছেন- আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরিফ আহাম্মেদ, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারী, আবুল হাসেম ও মো. হারুন।
কিশোরগঞ্জের মোট পাঁচজন অন্য একটি মামলাটির আসামি। তারা হচ্ছেন করিমগঞ্জের দুই সহোদর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. নাসিরউদ্দিন আহমেদ ওরফে মোঃ নাসির ওরফে ক্যাপ্টেন এ টি এম নাসির ও কিশোরগঞ্জ জেলা বারের আইনজীবী মো. শামসুদ্দিন আহমেদ এবং কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান, হাফিজ উদ্দিন ও আজহারুল ইসলাম। পাঁচজনের বিরুদ্ধেই ট্রাইব্যুনাল-১ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও এ পর্যন্ত কেবলমাত্র গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন শামসুদ্দিন।
কক্সবাজারের মহেশখালীর এলডিপির নেতা কক্সবাজার চেম্বারের সাবেক সভাপতি সালামত খান উল্লাহ খান ওরফে আঞ্জুবর ওরফে ‘পঁচাইয়া রাজাকার’, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ রশিদ মিয়া ও জাকারিয়া সিকদার- এ তিনজন একটি মামলার আসামি। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর প্রথম দু’জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা দুই সহোদর হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া ও মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া অন্য একটি মামলার আসামি।
অন্য একটি মামলার চার আসামি হলেন মৌলভীবাজার জেলার আলাউদ্দিন চৌধুরী, আকমল আলী, লাল মিয়া এবং মো. মতিন মিয়া।
মৌলভীবাজার জেলারই অন্য তিনজন আলবদর কমান্ডার শামসুল হক, রাজাকার কমান্ডার নেছার আলী ও রাজাকার কমান্ডার ইউনুছ মৌলভী একটি মামলার আসামি।
রাজাকার আজিজ (হাবুল) ও রাজাকার আব্দুল মতিন নামক দুই সহোদর এবং মনির আলী- এ তিনজন অন্য একটি মামলার আসামি, তাদের বাড়িও মৌলভীবাজার জেলায়।
ময়মনসিংহ জেলার একটি মামলায় তদন্ত চলছে মো. রিয়াজ উদ্দিন ফকির ও মো. আমজাদ আলী নামক দুই আসামির বিরুদ্ধে।
অন্য ১৩ মামলায় একজন করে ১৩ আসামি রয়েছেন। তারা হচ্ছেন- গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা যশোরের জামায়াতের সাবেক এমপি মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, চট্টগ্রামের রাউজানের বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের গিকা চৌধুরী, কক্সবাজার জেলার পেকুয়ার মহসীন হায়দার চৌধুরী, নেত্রকোনা জেলার আব্দুল খালেক তালুকদার, ময়মনসিংহ জেলার আবুল ফালাহ মুহাম্মদ ফাইজুল্লাহ, গাইবান্ধা জেলার আবু সালেহ মো. আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ, ঢাকা জেলার সৈয়দ মোহাম্মদ হুসাইন ওরফে হোসেন, গোপালগঞ্জ জেলার এনায়েত মোল্লা, নোয়াখালী জেলার আমির আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এমদাদুল হক ওরফে টাক্কাবালী, হবিগঞ্জ জেলার লিয়াকত আলী, পটুয়াখালী জেলার আয়নাল খা এবং পটুয়াখালী জেলার আশ্রাব আলী খান।
এছাড়া তদন্ত সংস্থা ছাড়া পাওয়া ১১ হাজার দালালের বিরুদ্ধে তদন্তকাজ এগিয়ে রাখতে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছেন। অন্য মামলার তদন্তের সময় পাওয়া যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি ১৯৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা প্রমাণপত্রও। সেগুলোও সংরক্ষণ করছেন তদন্ত সংস্থা। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে ভবিষ্যতে সুযোগ হলে দেশি-বিদেশি এসব যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরুরও আশা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ছাড়া পাওয়া ১১ হাজার দালাল এবং পাকিস্তানি ১৯৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও নতুন করে তদন্ত শুরু করার প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। দু’টি বিষয়ই নির্ভর করছে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপরে। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে তারা অবশ্যই এগোবেন।
তিনি জানান, অন্য মামলার তদন্তের সময় পাওয়া যাচ্ছে ১১ হাজার দালালের বিরুদ্ধে কাগজপত্র। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো খতিয়ে দেখে রিভিউ করতে হবে। কে কে জীবিত আছেন, কে কে মারা গেছেন- এসব বিষয়ও বিবেচনায় নিয়ে পুনর্তদন্ত করতে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছেন তারা।
তিনি জানান, পাওয়া যাচ্ছে পাকিস্তানি ১৯৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা প্রমাণপত্রও। সেগুলোও সংরক্ষণ করছেন তদন্ত সংস্থা। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে ভবিষ্যতে সুযোগ হলে দেশি-বিদেশি এসব যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরুরও আশা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। বিচার প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করতে তিন সদস্যের দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১২ সালের ২২ মার্চ।