কাজিরবাজার ডেস্ক :
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নসহ ইন্টানেট, ডিশ, সেলফোনের সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুক্রবার গভীর রাতে প্রথমে কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর পর শনিবার সকাল থেকে একে একে ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ব্যবহারের জন্য পানি রাখার ড্রামও কার্যালয়ের ভেতরে নিতে দেয়া হয়নি। এছাড়া দুপুরের পর কার্যালয় এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়। কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও টেলিভিশনের ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাকে ‘নিকৃষ্ট নিষ্ঠুর’ আচরণ হিসেবে অভিহিত করেছেন পুত্রশোকে আচ্ছন্ন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এলডিপি চেয়ারম্যান কর্ণেল (অব.) অলি আহমদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। তারা বলেন, বল প্রয়োগ করে বা জোর-জুলুম করে কিংবা নির্যাতন করে কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়া নিজের কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান ও তাদের দুই মেয়ে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, নিরাপত্তা সমন্বয়কারী (অব.) কর্ণেল আবদুল মজিদ, প্রেস উইংয়ের সদস্য শাইরুল কবির খান, শামসুদ্দিন দিদার প্রমুখ। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দলের সদস্য ও কার্যালয়ের কর্মচারীরা সেখানে রয়েছেন।
শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করলে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কাটার হুমকি দেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এর পর মধ্যরাতে ওই কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ৩ জানুয়ারি রাতে গুলশানের কার্যালয়ে যাওয়ার পর সেখানেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। কার্যালয় থেকে বেরোনোর সব পথে পুলিশের গাড়ি ও জলকামান, ইট-বালু-সুরকির ট্রাক রেখে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে সেখানেই অবস্থান নেন তিনি। এভাবে টানা ১৬ দিন পার করেন। অবরুদ্ধ অবস্থায় এ কার্যালয়ের প্রধান ফটকসহ দুটি ফটকেই দফায় দফায় তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। ১৯ জানুয়ারি রাতে তার কার্যালয়ের সামনে থেকে প্রতিবন্ধকতা তুলে নেয়া হলেও সেখানেই অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া।
বিকালে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান জানান, কার্যালয়ে উপস্থিত নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনাকে সরকারের ‘নিকৃষ্ট নিষ্ঠুর’ আচরণ বলে অভিহিত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, এর প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমি স্তম্ভিত। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নসহ সব ইউলিটি সেবা বন্ধ করে দেয়া একটা নজিরবিহীন ব্যাপার ও শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ। কোনো সভ্য সরকার এ ধরনের আচরণ করতে পারে না। সভ্য জগতে এটা কল্পনাতীত। বিনা নোটিশে নাগরিক সেবা বন্ধ করে দেয়া আইনপরিপন্থী। এটা মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে গুলশানের বাসায় বালুর ট্রাক রেখে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনা উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের আগে আমার বাসা ঘিরে যা ঘটানো হয়েছিল, এবার আমার কার্যালয় ঘিরে তারচেয়েও নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সরকার স্থাপন করেছে। প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান বলেন, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে কার্যালয়ের ভেতরে মোবাইল সংযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। ভেতরের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এমনকি ফ্যাক্সও কাজ করছে না।
শুক্রবার রাত ২টা ৪০ মিনিটে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের পুরো এলাকা হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় ডেসকোর একটি গাড়ি ও গুলশান থানা পুলিশের একটি হোন্ডায় দুই কর্মকর্তা মুখে কাপড় বেঁধে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দ্রুত চলে যায়। এ সময় সেখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরা ডেসকোর গাড়িটি ঘিরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কারণ জানতে চান। ডেসকোর লাইনম্যান মোকসেদ আলী জানান, গুলশান থানার নির্দেশে তিনি খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন।
রাতে কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা অন্ধকারে কাটিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ভোর ৪টার পর কার্যালয়ের ভেতরে থাকা জেনারেটর চালু করা হয়। এর আগ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন অন্ধকারেই সময় কাটান। কার্যালয় সূত্র জানায়, সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সময়ও খালেদা জিয়া জেগে ছিলেন। সঙ্গে প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও দুই মেয়ে ছিলেন। চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পর অনেক আতঙ্কের মধ্যে সবার সময় কেটেছে। জেনারেটর চালু হলেও আর ঘুমানো যায়নি। তিনি বলেন, জেনারেটর দিয়ে চেয়ারপারসনের কক্ষ ও নিচ তলায় অফিস কক্ষে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। কার্যালয়ের বাকি অংশ বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছে। রাতে কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর সকালে ইন্টারনেট ও ডিশের সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
সকাল থেকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপাসনের কার্যালয় এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়নি। কার্যালয় ও আশপাশে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। অন্য অপারেটরের সংযোগও ঠিকমতো মিলছে না। অপারেটরদের একটি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার অফিস সংলগ্ন মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়েছে। এতে ওই অফিস ছাড়াও আশপাশের প্রায় ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ধারিত এলাকায় তিনটি ফোন কোম্পানির বেশ কয়েকটি বেজ স্টেশন রয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানের কার্যালয়ের গেটের সামনে থেকে ছয় নারী আইনজীবীকে আটক করেছে পুলিশ। এ নারী আইনজীবীরা কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসার পর তাদের আটক করা হয়। তারা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহিলা সদস্য বলে জানা গেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল। বিকালে কার্যালয়ের বাইরে মহিলা দলের নেতাকর্মী মোমবাতি জ্বালিয়ে এ প্রতিবাদ জানান। এ সময় তাদের ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত ৯টায় প্রায় ২০ ঘণ্টার পর পুনরায় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।