কাজিরবাজার ডেস্ক :
কোমর বেঁধেই মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি। একের পর এক চলছে প্রাণঘাতী রাজনৈতিক কর্মসূচি। ক্ষমতার লড়াইয়ে কেউ কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। শুরু হয়েছে একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলা বা গুপ্তহত্যা। পথে-ঘাটে প্রতিনিয়তই রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে নিরীহ সাধারণ মানুষ। বিরোধী পক্ষের ইটের জবাব দেয়া হচ্ছে পাটকেল দিয়েই। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কঠোর অবস্থানের ঘোষণা ও নানা বক্তব্য এবং দুই দলের নেতাদের সাংঘর্ষিক মন্তব্যে সঙ্কটময় পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হচ্ছে। একদিকে ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে আগুন, পেট্রোলবোমা হামলা, অন্যদিকে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির অভিযান-গুলি, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। খুব সহসা এ পরিস্থিতির উত্তরণ কিংবা শান্তিময় পরিস্থিতি ফেরার সম্ভাবনা দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি, কূটনৈতিকসহ দেশি-বিদেশি নানা মহলের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের পথ খুঁজতে আহ্বান জানানো হলেও ক্ষমতাসীনরা তাতে পাত্তাই দিচ্ছে না। অধিকাংশ সিদ্ধান্তেই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এতে করে জনজীবন এখন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু হাল ছাড়ছে না কেউই। তাই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ‘দেশ অচলের কর্মসূচি’ প্রতিরোধে নতুন কৌশলে এগোচ্ছে সরকার। পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের ভাষায় ওই সন্ত্রাসীরা হচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মী। সন্ত্রাস বিরোধী এ কমিটি আইন হাতে তুলে নিয়ে বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতিহত করার এ ঘোষণাটি আরও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের একাধিক উচ্চপর্যয়ের কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে কোনো উপায়ে বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু জেলায় শুরু হয়েছে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বশূন্য করতে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতারেও একটি ছক তৈরি করা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রভাবশালী কর্মীদের গ্রেফতারে তালিকা ধরে চলছে অভিযান। এরই মধ্যে বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতার খোঁজে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছে। জানা গেছে, সার্বিক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাদের ওপর দমন-পীড়ন আরও বাড়িয়ে দেয়া হবে। এই এক সপ্তাহে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্বদানকারী প্রায় হাজারখানেক নেতাকে গ্রেফতারের পরিকল্পনাও হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীল এ পরিস্থিতে দেশের বিশিষ্ট মহল থেকে শুরু করে সবখানেই দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এভাবে চলতে থাকলে আরও ঝরে যাবে তাজা প্রাণ। নির্মমতার শিকার হবে খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে বিএনপির অনির্দিষ্টকালের অবরোধে ১১ দিনে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে শিশুসহ ২৪ নিরীহ মানুষ। আহত ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ব্যাপক। তবে এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বিএনপির কর্মসূচির মধ্যেই চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিতে আগামী এক সপ্তাহ সর্বোচ্চ কঠোরতা প্রদর্শনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যে কোনো মূল্যে সারা দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা যা করণীয় তার সবকিছুই করবে সরকার। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার পিলখানায় বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, বিজিবি কোথাও আক্রান্ত হলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেবে। পিকেটার বা যানবাহনে বোমা নিক্ষেপকারীদের গুলি করে হতাহতেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তার একদিন পর শুক্রবার রংপুরে মিঠাপুকুরে গিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, অবরোধকারীরা বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারছে। কী কারণে জনগণকে এভাবে মারা হচ্ছে? তারা যতই সন্ত্রাসী কর্মকা- করুক না কেন, এবার আর পার পাবে না। একই অনুষ্ঠানে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, নির্ধারিত সময়ে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা ২০১৩ সালে সন্ত্রাসীদের রুখে দিয়েছিলাম, এবারও রুখে দেব। এদিকে আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে সরকার বিএনপির অবরোধ কর্মসূচিতে যা ঘটছে তা আন্দোলন নয়, বরং নাশকতা হিসেবেই বিদেশিদের দেখানোর কৌশল নিয়েছে। এটি সঠিকভাবে করতে পারলেই আওয়ামী লীগ মনে করছে আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নাশকতাকারীরা বাধ্য করছে। সহ্যের একটি সীমা আছে। একের পর এক নাশকতায় যখন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তখন সরকার আর বসে থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। কেউ সাধারণ জনগণের জীবন নিয়ে খেলার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নেবে। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, ৮ জানুয়ারি রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অবরোধের নামে নাশকতার বিরুদ্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বনের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দলের নেতাকর্মীদের সরকার বিরোধী যে কোনো সহিংসতা মোকাবিলায় রাজপথে সক্রিয় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার নির্দেশ দেন। একই দিনে সচিবালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদোনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছর জানুয়ারিতে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এবার ভাবিনি, এ পরিস্থিতিটা এত লম্বা হবে।’ এদিকে বুধবার সকালে চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, শিগগিরই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।