ডা. কামরুল হাসান খান :
গত ৩ জুন সরকার করোনাকালে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করে এক চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই যে মুহূর্তে গোটা বিশ্ব কোথাও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, কোথাও তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলা করছে। বেড়েই চলেছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার এবং বিপর্যস্ত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা, শিক্ষা-সমাজ-সভ্যতা। সব বিবেচনায় বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট ভালো আছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। টিকা সংগ্রহে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছে। গ্রহণ করেছে সব বিষয়ে সময়োচিত সিদ্ধান্ত, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দিয়েছে প্রণোদনা। পর্যুদস্ত পরিস্থিতিতে জিডিপি নিয়ন্ত্রণে, অর্থনীতির চাকা সচল। বেড়েছে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ২২৭ ডলার, ব্যাংক রিজার্ভ ৪৫.৫ বিলিয়ন ডলার।
সরকার নতুন জাতীয় বাজেটের আকার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ঘোষণা করেছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। চলতি বাজেটে মোট স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির ১ শতাংশের কম এবং মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ১১০ ডলার। এ কারণে করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দও সব সময় অপর্যাপ্ত থেকেছে। বাজেট যা-ই হোক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবার ব্যবহারের সক্ষমতারও অভাব রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাত ঘিরে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছে সরকার। এসব বিষয় মাথায় রেখেই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। ফলে মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ বরাদ্দ পেতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১.৩ শতাংশ এবং গত বাজেট থেকে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এটি মোট বাজেটের ৫.২ শতাংশ। সে হিসাবে চলতি অর্থবছর থেকে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে তিন হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। বাড়তি এই বাজেটের বড় একটি অংশই অবশ্য খরচ হবে পরিচালনা খাতে। বাকিটা মূলত ব্যয় হবে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে। এই বাজেট থেকে প্রতিবছর বড় একটি অংশ চলে যায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির পেছনে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিটাও বিবেচনায় রাখতে হয়।
স্বাস্থ্য বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাত অর্থবছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে, জনসংখ্যা অনুপাতে দেশের হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ শয্যার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালে ৫০৮টি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৭৩৭টি আইসিইউ শয্যা আছে।
এখন সরকার যে মাস্টারপ্ল্যান করার পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখানে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সরঞ্জাম বাড়ানো হবে। ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ জন্য এসব সরঞ্জাম আমদানি করমুক্ত থাকবে। এর পাশাপাশি করোনা মোকাবেলায় নতুন দুই হাজার চিকিৎসক, ছয় হাজার নার্স ও ৭৩২ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে। এর জন্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। চলতি বাজেটে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের সংখ্যা ও সেবার মান বাড়াতে বরাদ্দ রয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা।
করোনাকালে এখন পর্যন্ত ১৫০ জনের বেশি চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চলতি বাজেটে চিকিৎসকদের সম্মানী ভাতার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসকদের পরিবারকে এককালীন সম্মানী ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। আগামী বাজেটে এই ভাতার পাশাপাশি দেওয়া হতে পারে ঝুঁকি ভাতা। সেই সঙ্গে আসতে পারে প্রণোদনার ঘোষণা। প্রণোদনা এবং এসব ভাতার জন্য আগামী বাজেটে বরাদ্দ থাকছে ৮৫০ কোটি টাকা।
করোনা মোকাবেলা, বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা কেনা বাবদ সরকার চলতি অর্থবছর ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রেখেছে। করোনার প্রকোপ এখনো কমেনি, বরং দিন দিন তা পৃথিবীজুড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এ বিবেচনায় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার আগামী বাজেটেও ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রেখেছে। আগামী বাজেটে সব নাগরিকের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে চার হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এটি ছয় হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে আধুনিক সেবা ও অনলাইনে বিশেষায়িত সেবার ঘাটতি দেখা গেছে করোনাকালে। চলতি অর্থবছর এ খাতে ১৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ সেবার মান বাড়াতে আগামী বাজেটে তা ২০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
দেশের স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে গবেষণার জন্য বাজেটে আবারও বরাদ্দ দিতে যাচ্ছে সরকার। আগামী বাজেটেও এ খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছর ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠন করে সরকার। এ জন্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে এই তহবিল থেকে কোনো টাকা খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের গবেষণার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র পাঁচ কোটি টাকা।
বাজেটে জীবন বাঁচাতে সবাইকে বিনা মূল্যে টিকা প্রদানের উল্লেখ রয়েছে। এ জন্য ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা প্রদানের মাধ্যমে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
৫০ বছরের বাংলাদেশ নানা অস্থিরতায় ছিল। লম্বা সময় সামরিক শাসন, হত্যা-ক্যু আর দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল। যেকোনো মূল্যায়নেই বিবেচনায় রাখতে হবে দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান। এত প্রতিকূল পরিস্থিতির পরেও স্বাস্থ্য খাতের বেশ কিছু অর্জন বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। বাস্তব সীমাবদ্ধতা রয়েছে অনেক। মাথাপিছু আয় প্রায় দুই হাজার ২২৭ ডলার। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বাস্তবিক সক্ষমতার স্তরের কোনো পরিমাপ নেই। সেখানে সক্ষমতার তুলনায় দেশের মানুষের স্বাস্থ্যচাহিদা আকাশচুম্বী, সে কারণে অসন্তুষ্টিই হচ্ছে বাস্তবতা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মান সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের ওপরে এবং শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নিচে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার চতুর্থ (২০১৭-২০২২) স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, পুষ্টিবিষয়ক উন্নয়ন কর্মসূচি (ঐচঘঝচ) গ্রহণ করেছে, যা বাস্তবায়নাধীন। এক লাখ ১৫ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকার এই বিশাল বাজেটের প্রকল্পে বিশেষভাবে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে ১. সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ রোগীর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে সংক্রামক রোগ), ২. পুষ্টি, ৩. খাদ্যনিরাপত্তা এবং ৪. মানবসম্পদ উন্নয়ন।
নিম্নমধ্যম আয় থেকে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্থাৎ সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মতে, যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় নাগরিকরা আর্থিক অসচ্ছলতা থেকে মুক্ত না হয়েও স্বাস্থ্য সুবিধা পেতে পারে, সেটাই হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্প্রসারণ সন্তোষজনক। বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এবং দুর্বলতা আছে, যা কাটিয়ে উঠলে গ্রহণযোগ্য একটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে অর্থনীতির স্বাস্থ্য আরো ভালো হবে। সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন, এই মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা ও কেনাকাটায় স্বচ্ছতা এবং অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে না উঠলে বাজেট যতই বাড়ানো হোক, তা কোনো কাজে লাগবে না।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।