কাজিরবাজার ডেস্ক :
অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে কারাগারে ঠাঁই হলো সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। তার গ্রেফতার দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলার মধ্যেই গতকাল দুপুরে ধানমন্ডি থানায় আত্মসমর্পণ করেন তিনি। থানা পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করলে আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। থানা থেকে আদালত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পথে সাংবাদিকরা তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও তিনি কোন কথা বলেননি। এদিকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার দাবিতে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামী দল ও সংগঠনের দেয়া কর্মসূচি স্থগিত করে তার দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
এর আগে রবিবার রাতে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে হঠাৎ করেই দেশে ফেরেন আওয়ামী লীগের সাবেক এই প্রেসিডিয়াম সদস্য। দেশে ফিরেই চলে যান অজ্ঞাতবাসে। এরপর শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মপন্থি দলগুলো তাকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাতে থাকে। এমনকি বুধবারের মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার না করা হলে বৃহস্পতিবার হরতালেরও ডাক দেয় তারা। এদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ‘সবুজ সঙ্কেত’ ছিল না। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ডেকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর থেকেই তাকে গ্রেফতারে তোড়জোড় শুরু হয়। পুলিশ তার অবস্থানও জানার চেষ্টা করতে থাকে। তবে এর আগেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন লতিফ সিদ্দিকী। সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি পক্ষ তাকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেয়। এরপরই তিনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টা ২৪ মিনিটে ধানমন্ডি থানার সামনে একটি সিএনজি অটোরিক্সা এসে থামে। সিএনজি থেকে নেমে থানার ডিউটি অফিসারের রুমে যান সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার পরনে এসময় ধূসর রঙের প্যান্টের সঙ্গে চেক শার্ট ইন করা ছিল। পায়ে ছিল সাদা জুতা। ডিউটি অফিসার হিসেবে তখন ধানমন্ডি থানায় দায়িত্ব পালন করছিলেন এসআই ইফতেখারুল আলম প্রধান। লতিফ সিদ্দিকী তাকে প্রশ্ন করেন, ওসির রুম কোথায়? ডিউটি অফিসার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিকের কক্ষটি দেখিয়ে দেন। লতিফ সিদ্দিকী তার রুমে প্রবেশ করেন। মুহূর্তেই থানা হয়ে ওঠে সরগরম। ওসি তাৎক্ষণিক বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান। পুলিশ কর্মকর্তারা দ্রুত তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ১০ মিনিটের মাথায় লতিফ সিদ্দিকীকে নিজের গাড়িতে নিয়ে আদালতের দিকে রওনা দেন ওসি। সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য একাধিক পুলিশ ভ্যান ছুটতে থাকে পিছু পিছু। ডিএমপি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্রুত ফোর্স পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত পাড়ায়। দুপুর ২টা ১০ মিনিটে আদালত প্রাঙ্গণে লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে হাজির হয় পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে লতিফ সিদ্দিকীর আত্মসমর্পণ ও আদালতে নিয়ে যাওয়ার খবরে গণমাধ্যমের কর্মী ও উৎসুক মানুষ ভিড় করতে থাকে আদালতপাড়ায়। লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল করতে থাকেন আইনজীবীরা। পরে ২টা ২৮ মিনিটে মহানগর হাকিম আতিকুর রহমানের আদালতে হাজির করা হয় তাকে। ঢাকার আদালতে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে সাতটি মামলা দায়ের হয়েছিল। ছয়টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা ও একটিতে সমন জারি করেছিল আদালত। এর মধ্যে বিএনপিপন্থি এডভোকেট আবেদ রাজার দায়ের করা মামলায় লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আদালত লতিফ সিদ্দিকীকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কোন আইনজীবী নিয়োগ করেছেন কিনা?’ জবাবে লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন ‘না, আমি নিজেই কথা বলবো।’ পরে আদালত তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার পক্ষে কোন জামিন আবেদন করা হয়েছে কিনা?’ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি ‘না’ বলেন। পরে আদালত বাদীপক্ষকে শুনানি করতে বললে বাদী আবেদ রাজা নিজেই শুনানি করেন। তিনি আদালতকে বলেন, ২০০ মুসলমানের পক্ষে তিনি মামলাটি দায়ের করেছেন। লতিফ সিদ্দিকী ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন। তার সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।’ শুনানি শেষে আদালত বলেন, ‘যেহেতু আসামী জামিন আবেদন করেননি, সেহেতু তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়া হলো।’ শুনানি শেষে কাঠগড়ায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা লতিফ সিদ্দিকীকে এক আইনজীবী-সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনি দোষী না নির্দোষ?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে কিছুই বলবো না।’ পরে তাকে আবারও বলা হয়, আপনার বিরুদ্ধে আরও ওয়ারেন্ট আছে। তিনি বলেন, ‘এগুলো ভুল ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে।’ এরপর কোর্ট পুলিশ তাকে আবারও আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যান। সেখানে একটি প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় তাকে। বিকাল ৩টা ১ মিনিটে লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে কারাগারের দিকে রওনা হয় পুলিশ।
মিছিল-জুতা প্রদর্শন : হজ্ব নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় লতিফ সিদ্দিকীকে গতকাল দুপুরে আদালতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তাল হয়ে ওঠে আদালতপাড়া। বিক্ষুব্ধ আইনজীবীরা লতিফ সিদ্দিকীকে উদ্দেশ্য করে নানারকম স্লোগান দিতে থাকে। ‘লতিফ সিদ্দিকীর দুই গালে/জুতা মারো তালে তালে’ বলে স্লোগান দেয়া হয়। তাকে লক্ষ্য করে দেখানো হয় জুতা। নিক্ষেপ করা হয় থুতু। বিকালে তাকে যখন আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন একদল আইনজীবী হাতে জুতা নিয়ে প্রিজনভ্যানের গায়ে আঘাত করতে থাকেন। কেউ ঝাড়ু হাতেও প্রিজনভ্যানে আঘাত করেন। ভ্যানের উপরের নেটের অংশ দিয়ে ভেতরে থুতু নিক্ষেপ করার চেষ্টাও করেন কেউ কেউ। পরে পুলিশ প্রিজন ভ্যানের দুই পাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষুব্ধ আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অভিমুখে চলে যায় প্রিজন ভ্যানটি।
এ দু’দিন কোথায় ছিলেন? আত্মসমর্পণের পর প্রশ্ন উঠে,ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার এই দু’দিন কোথায় ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। রোববার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন তিনি। কিছুক্ষণ অবস্থান করেন বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ দোলনচাঁপায়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলভার কালারের একটি গাড়িতে তিনি বেরিয়ে যান বিমানবন্দর থেকে। গণমাধ্যমকে ফাঁকি দেয়ার জন্য বেরিয়ে যান অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের গেট দিয়ে। এ দু’দিন তিনি অনেকটা অজ্ঞাতবাসেই ছিলেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরা লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। তাকে গ্রেপ্তারে স্পিকারের অনুমতি লাগবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এমন দাবির প্রেক্ষিতে স্পিকার বিষয়টি খোলাসা করে দেন। বলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারে স্পিকারের অনুমতির প্রয়োজন নেই। পরে সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ডেকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। এরপর তোড়জোড় শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে। এর আগে নানারকম অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি এড়িয়ে যান। বলেন, সরকারের ‘সবুজ সঙ্কেত’ পেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে। সোমবার রাতে গ্রেফতারের নির্দেশনা পাওয়ার পর উত্তরা এলাকায় হন্যে হয়ে লতিফ সিদ্দিকীর অবস্থান জানার চেষ্টা করেন গোয়েন্দারা। এমনকি তাকে বহনকারী গাড়িটিও চিহ্নিত করা হয়। পরে জানা যায় ধানমন্ডির ১২ নম্বর সড়কের একটি বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, আত্মসমর্পণ না করলে মঙ্গলবার রাতেই তাকে গ্রেফকার করা হতো।
উল্লেখ্য, গত ২৮শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী হজ্ব, মহানবী (সা:) ও সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে কটূক্তির পরপরই তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে ইসলামী দলগুলো আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয়। এরপর টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় লতিফ সিদ্দিকীকে। পরে দল থেকেও বহিষ্কৃত করা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এই সদস্যকে। এ ঘটনার পর লতিফ সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের কলকাতায় গিয়ে অবস্থান করেন। গত রবিবার রাতে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে হঠাৎ করেই ঢাকায় হাজির হন তিনি। টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের জ্যেষ্ঠ ভাই ৭৭ বছর বয়সী লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। গত মহাজোট সরকারের আমলে তিনি পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।