আজ আমার পিতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। যদিও তিনি আমার পিতা তবুও তাঁর সম্বন্ধে লিখতে বসে আমাকে অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করে লিখতে হচ্ছে। তাঁর নামটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সিলেটের সকল সংগ্রাম আন্দোলন ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। আমি যতটুকু পেরেছি বিভিন্ন বই-ইতিহাস পড়ে এবং আমার জানামতে তা শুদ্ধ করে লিখার চেষ্টা করেছি। তারপরও যদি কোন ভুল-ভ্রান্তি আপনারা পেয়ে থাকেন আমাকে বলে দিবেন, মাফ করবেন। এখনও বেঁচে আছেন আমার পিতার অনেক সহযোদ্ধা।
দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন হযরত শাহজালাল (রহ.) সহচর ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ তাজউদ্দীন কোরেশী (রঃ) বংশধর। ১৯২৪ খৃঃ ১লা মার্চ বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানা দিনারপুর পরগণার দেবপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। আমার দাদার নাম মরহুম দেওয়ান হামিদ গাজী ও দাদী মোছাম্মত ছলিমা খাতুন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মা-বাবার ২য় সন্তান। আমার আম্মা মরহুমা আলম রওশন চৌধুরী (পুষ্প)। আমার আম্মা ছিলেন ফুলবাড়ী নিবাসী মরহুম আব্দুজ জহির চৌধুরীর মেয়ে, আম্মার নানা ছিলেন দেওয়ান একলিমুর রাজা (মরমী কবি হাছন রাজার ছেলে)। আমার পিতার রাজনৈতিক জীবনে সাফল্য ও জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা লাভের পিছনে আম্মার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। ১৯৯৫ সালের ৩রা নভেম্বর আমার আম্মা ইন্তেকাল করেন। আমরা ভাই-বোন ৭ জন।
দেওয়ান ফরিদ গাজী একটি সংগ্রামী জীবনের নাম। একটি ইতিহাসের নাম। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর বাবা মারা যান। উনার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন মৌলভীবাজার জুনিয়র মাদ্রাসায়। থাকতেন মোস্তফাপুর উনার আত্মীয়ের বাসায়। কৃতি ছাত্র হিসেবে বৃত্তিও লাভ করেন। পরে সিলেটে এসে সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিছু দিন সেখানে লেখাপড়া করে মাদ্রাসা শিক্ষা পরিবর্তন করে ভর্তি হন রসময় মেমোরিয়াল হাই স্কুলে। রসময় থেকে ১৯৪৫ সালে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন মেট্রিক পরীক্ষা। ভর্তি হন এম.সি. কলেজে (তখন কলকাতার অধীনে ছিল)। সেখান থেকে আই.এ. পাস করেন। তারপর ভর্তি হন মদন মোহন কলেজ, সিলেটে (তখন ঢাকা ভার্সিটির অধীনে)। সেখান থেকে বি.এ. পাস করেন। যদিও জমিদার পরিবারে জন্ম, তবুও জন্মের পর দেখেছেন আপন সমাজ ও দেশের পশ্চাৎপদতা দারিদ্র, হতাশায় নিমজ্জিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনা ও বেদনার করুণচিত্র। তিনি ভোগ ত্যাগ করে জমিদারের আভিজাত্য ছেড়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে দেশ, জাতি ও সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনে অতি অল্প বয়সে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪২ খৃঃ দেওয়ান ফরিদ গাজী যখন স্কুলের ছাত্র তখন থেকেই ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের মাধ্যমে কংগ্রেসের সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট কংগ্রেস’ এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে এম.সি কলেজে পড়া অবস্থায় শুরু হয় তাঁর ছাত্র রাজনীতির জীবন। মুসলিমলীগের অংগসংগঠন আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হলে দেওয়ান ফরিদ গাজী আসাম প্রাদেশিক শাখার সহ-সম্পাদক এবং এম.সি. কলেজ শাখার সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময়ের আরো ছাত্রনেতারা ছিলেন মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, তছদ্দুক আহমদ চৌধুরী, এ.টি.এম. মাসুদ, পীর হাবিবুর রহমান প্রমুখ নেতাগণ। মৌলানা ভাসানীর আহ্বানে আসামে বাঙাল খেদাও অভিযানের প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই গাজী সাহেবের প্রতিবাদী রাজনৈতিক জীবনের শুরু।
১৯৪৬ সালে আসামের গোয়ালপাড়া শহরে আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের এক বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট জেলা ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এ সম্মেলনে যোগদান করেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ১৯৪৬ খৃঃ নয়াসড়ক জামে মসজিদে সিলেটের সংগ্রামী মুসলিম ছাত্রজনতা ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সমর্থকদের মাঝে এক তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে তখনকার ছাত্রনেতা ফরিদ গাজী মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হন এবং বেশ কিছুদিন লাগে সুস্থ হতে।
১৯৪৭ সালে সিলেটে গণভোটের সময় ছাত্রনেতা ফরিদ গাজী এডভোকেট আব্দুল হাফিজ সাহেবের (আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীর পিতা) একখানা চিঠি নিয়ে শিলং যান আসাম মুসলিমলীগ নেতা ও আসাম প্রাদেশিক সরকারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহর কাছে। স্যার সাদুল্লাহ নিজস্ব তহবিল থেকে গণভোটের আর্থিক অনুদান নগদ ২০ হাজার টাকা ও একটা চিঠি দেন গাজী সাহেবের কাছে। শিলং থেকে ফেরার পথে সারী নদীতে ফেরি নৌকা পাহাড়ী ঢলে ভেসে আসা একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। তিনি নদীর তীব্র স্রোতে ভাসতে ভাসতে অনেক দূর গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন। তখন চ.ড.উ এর উদ্ধারকারী দল তাঁকে উদ্ধার করে আনে এবং হরিপুর ডাকবাংলাতে উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে তিনি টাকা ও চিঠি খুঁজতে থাকেন। কোটের ভেতরের পকেটে একটি ছোট ব্যাগে টাকা ও চিঠি যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে দেখে তিনি আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। এই ২০ হাজার টাকা এখনকার ২০ লাখ টাকা। পরের দিন সুস্থ হয়ে শহরে পৌঁছে টাকা ও চিঠি আব্দুল হাফিজ সাহেবের কাছে দিলেন। গাজী সাহেবের দুর্ঘটনা ও দুঃসাহসিক অভিযাত্রার কথা শুনে সবাই অবাক হলেন। এমনি ভাবে দেশপ্রেমিক, নির্ভিক ছাত্রনেতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু। ১৯৪৭ সালে গণভোটে দেওয়ান ফরিদ গাজী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুসলিমলীগ ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের নেতাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৪৭ সনে ৬ই এবং ৭ই জুলাই অনুষ্ঠিত গণভোটে জয়লাভ করে সিলেট জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। গণভোটের সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ রাজনৈতিক নেতারা সিলেটে আসেন এবং তাঁদের সাথে ফরিদ গাজী ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত হন। একজন উদীয়মান, দক্ষ ছাত্রনেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বঙ্গবন্ধু যখন সিলেট আসেন অন্যান্য নেতাদের সাথে তখন তিনি ছিলেন ছাত্রনেতা ইসলামিয়া কলেজ, কোলকাতা ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। ঐ সময় বঙ্গবন্ধু ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর পরিচয় হয়। এই তরুণ ছাত্রনেতার কর্তব্যনিষ্ঠা, অসীম সাহস, অমায়িক ব্যবহার ও বিচক্ষণতা বঙ্গবন্ধুকে আকৃষ্ট করে এবং তিনি হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র ও ঘনিষ্ঠ সহচর। কলকাতা থেকে আগত ছাত্রনেতারা থাকতেন শিবগঞ্জ সোনারপাড়া বখতিয়ার বিবি বালিকা বিদ্যালয়ে। নির্বাচনী কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে গাজী সাহেবের উপর বখতিয়ার বিবি বালিকা বিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রনেতাদের দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। তাই গাজী সাহেব প্রায় সব সময়ই থাকতেন শেখ সাহেবের সাথে। ফলে গাজী সাহেব শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু সে স্কুলটির কথা স্মরণ রেখেছিলেন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্কুলটির জন্য অনুদানও দিয়েছিলেন।
১৯৫০ খৃঃ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সে সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক স্বল্পতা দেখা দিলে তিনি কিছুদিন সিলেট গভঃমেন্ট হাই স্কুলে এবং রসময় স্কুলে শিক্ষকতাও করেন। ১৯৫২ইং থেকে ১৯৫৫ইং পর্যন্ত তিনি সিলেটের প্রাচীনতম ‘সাপ্তাহিক যুগভেরী’ পত্রিকার পাশাপাশি ইংরেজী পত্রিকা ‘ইস্টার্ন হেরাল্ড’ এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতি, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা- তিনটি অঙ্গনে তিনি একসাথে বিচরণ করেছেন এক সময়। (চলবে)