॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
নারীদের রাস্তায় নম্রভাবে চলাচল : ইসলামী অনুশাসন হল নারীরা সাবধানতার সাথে রাস্তার একপাশ দিয়ে চলাচল করবে নম্র ও শালীন ভাবে। কিন্তু তারা যদি অহংকারের সাথে রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল করে, তবে তাদের ইভটিজিং এর সম্মুখীন হওয়া অতি সাধারণ। তাই ইসলামী অনুশাসন মান্য করা জরুরী। মহান আল্লাহ বলেন, তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদাচারণা না করে। “আল-কোরআন,২৪: ৩১”
পোশাকের ব্যাপারে ইসলামী বিধানমালা অনুসরণ : নারীর পোশাকের ব্যাপারে ইসলামী বিধ-বিধানের কয়েকটি হলো-
* সতর পরিমাণ ঢেকে থাকে এমন ঢিলে ঢালা পোশাক পরিধান করা;
প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক না পরা; আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন: “তারা তাদেও সৌন্দর্যকে যেন প্রকাশ না করে। (আল-কুরআন, ২৪: ৩১)
* জাহিলিয়াতের ন্যায় নগ্নপোষাক না পরা; “মাহন আল্লাহ বলেন: “জাহিলী যুগের ন্যায় তোমরা সৌন্দর্যকে প্রদর্শন করো না।” (আল-কুরআন, ৩৩: ৩৩)
* পোষাক স্বচ্ছ পাতলা না হওয়া; “পর্দার উদ্দেশ্য আবৃত করা এবং তাদনুযায়ী সাফল্যের জন্য পাতলা স্বচ্ছ কাপড় দ্বারা পর্দা তৈরী করা ঠিক হবে না। নামে মাত্র পর্দা আর বাস্তবতায় অনাবৃত এ হতে পার না। মহানবী (সা.) বলেন, “আমার শেষ জামানার উম্মতের নারীরা পোষাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করলেও প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে উলঙ্গ মনে হবে, তাদের চুলের খোপাকে মনে হবে যেন বুখ্ত উটের কুঁজোর মতো সুউচ্চ। তাদের অভিশাপ দাও, কেননা তারা অভিশপ্ত।” (আত-তাবারানী, মুজামুস সাগীর, অধ্যায়: বাবুল হা’, অনুচ্ছেদ: মান ইসমুহু হারুন, বৈরুত: মাকতাবাতুল ইসলামী, ১৪০৫ হি., হাদীস নং-১১২৫)”
* পোষাক আঁটসাঁট না হওয়া; “পর্দা ফেৎনা হতে বাঁচার রক্ষাকবচ। এটা আঁটসাঁট হলে নারী-পুরুষের দেহ গঠন প্রণালী প্রকাশিত হবে এবং তাতে পর্দার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। এ প্রসঙ্গে উসামা ইবনু যায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রাসূলূল্লাহ (সা.) আমাকে একটি কুবতী মোটা আঁটসাঁট কাপড় পরার জন্য দিলেন, যা তাঁকে দাহ্ইয়া আল-কালবী (রা.) উপঢৌকন দিয়েছিলেন। আমি কাপড়টি নিয়ে আমার স্ত্রীকে পরার জন্য দিয়েছিলাম। রাসূলূল্লাহ (সা.) তা জানতে পেরে বললেন: কী? ব্যাপার, তুমি কুবতী কাপড়টি পরলে না? আমি জবাব দিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.), আমি কাপড়টি আমার স্ত্রীকে পরার জন্য দিয়েছি। তখন রাসূল (সা.) বললেন: তোমার স্ত্রীকে এ নির্দেশ দেবে, যেন সে এর নিচে একটি অর্ন্তবাস পরে নেয়। কেননা আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, এতে তার হাড়গুলোর আকৃতি বাহির থেকে ফুটে ওঠতে পারে।” (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায়: মুসনাদে আনসার, অনুচ্ছেদ: হাদীসে উসামা বিন যায়েদ হুব্বে রাসূল (সা.), দামেশক: মআস্্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২১ হি., হাদীস নং- ২১৭৮৬)
* নারী-পুরুষের পোষাকে সাদৃশ্য না হওয়া; “এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন: “যে নারী পুরুষের বেশ ধারণ করে আর যে পুরুষ নারীর বেশ ধারণ করে, তারা আমাদের দলের নয় অর্থাৎ তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়।” (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, অধ্যায়: মুসনাদে মুকসিরীনা মিনাস সাহাবা, অনুচ্ছেদ: মুসনাদে আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৬৮৭৫)
* মুসলিমের পোশাক বিজাতীয় পোষকের ন্যায় না হওয়া; “এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্য (পোশাক-পরিচ্ছেদ ও সংস্কৃতিতে) রাখে, সে তাদের অন্তর্ভূক্ত।” ( ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-লিবাস, অনুচ্ছেদ: বাবু ফি লুবসিস শুহরাতি, বৈরুত: মাকতাবাতুল আসরীয়া, তা.বি, হাদীস নং-৪০৩১)
* যশ-খ্যাতির উদ্দেশ্যে পোশাক না পরা; “এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি দুনিয়ার খ্যাতিজনক পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরিধান করাবেন, অতঃপর জাহান্নামে নিক্ষেপ করে আগুনে জ্বালাবেন।” (ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-লিবাস, অনচ্ছেদ: বাবু মান লাবিসা শুহরাতান মিনা লিবাসি, বৈরুত: দারে ইহইয়া কিতাবুল আরাবীয়্যাহ, তা. ডব., হাদীস নং-৩৬০৭)
সর্বোপরি ইসলাম নির্দেশিত পোশাকের বিধান অনুসারে হিজাব অনুশীলনের মাঝেই নারীর সঠিক মর্যাদা ও কল্যাণ নিহিত। বেপর্দার কারণেই নারী নির্যাতন, ইভটিজিং সমাজে আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কোরআনের এ সুন্দর বিধানকে উপেক্ষা করে আজকের সমাজে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চাকুরীজীবীদের কর্মস্থল ইত্যাদিকে শালীনতা বিবর্জিত ও ইসলাম বিরোধী পোশাকের প্রচলন করা হয়েছে। যা ইভটিজিং এর মতো অনভিপ্রেত অপরাধ বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং ইভটিজিং বন্ধে ইসলামী পোশাক প্রচলন জরুরী। বাংলাদেশে সংঘটিত ইভটিজিং এর অধিকাংশই নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শন ও অশ্লীল পোশাক পরিধানের কারণেই হয়ে থাকে। “সারণি-৪ দেখুন।”
নারীদের সুগন্ধি ব্যবহার : যেহেতু সুগন্ধি ইন্দ্রিয়গুলোকে উত্তেজিত করে, তাই মহানবী (সা.) মহিলাদেরকে খোশবু লাগিয়ে বাইরে বের না হবার হুকুম দিয়েছেন। আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোন মহিলা যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে, অতঃপর মানুষের পাশ দিয়ে হাঁটে, যাতে তারা তার সুঘ্রাণ পায়, তবে সেই মহিলা ব্যভিচারিণী। ‘‘আবু আব্দুর রাহমান আহমদ বিন শুআইন আন-নাসায়ী, আস-সুনান, হালব: মাকাতাবাতু মাতবাআতু আল-ইসলামীয়্যাহ, ১৪০৬ হিজরী, হাদীস নং = ৫১২৬”। সুতরাং ইভটিজিং বন্ধে ইসলামী অনুশাসন মেনে নারীর উচিত হবে সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে বের না হওয়া।
পরপুরুষের সঙ্গে আবেদনময়ী স্বরে কথা না বলা : পরপুরুষের সঙ্গে নারীর কথা বলার ভঙ্গি ও ধরণ এমন হতে হবে, যাতে আলাপকারী পর পুরুষের মনে অশুভ চিন্তার উদয় না হয়। পরপুরুষের ক্ষেত্রে সর্বদা ইসলামের এই অনুশাসনটির কথা স্মরণ রাখতে হবে, যাতে করে কেউ নারীর কথার দ্বারা তার প্রতি আকর্ষিত না হয়। যার কুপ্রভাব হতে পারে ইভটিজিং এর মত জঘন্য কাজ। মহান আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। “আল-কোরআন, ৩৩: ৩২”
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন : ইভটিজিং একটি সামাজিক সমস্যা। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মাঝে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তারা বাস্তবতার তুলনায় আবেগ তাড়িত হয়েই মূলত এ সকল ঘৃণ্য কাজ করে। তাই তাদের সামনে যদি ইসলামী অনুশাসন শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে ইভটিজিং বন্ধে তা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। উদাহরণ স্বরূপ ঘঈঞই অনুমোদিত ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যকর সিলেবাসে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ইসলামী শিক্ষা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর প্রথম পত্র বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘ইভটিজিং প্রতিরোধের ধর্মীয় অনুশাসন’ অন্তর্ভুক্তি।
ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা : বর্তমান সমাজে প্রচলিত অপসংস্কৃতি মূলত ইভটিজিং এর প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। সুতরাং ইভটিজিং বন্ধ করতে হলে পশ্চিমা ও ভারতীয় অপসংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামী সংস্কৃতির উপর জো দেয়া জরুরী। বাংলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা জোরদারকরণে‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ যথার্থ প্রতিষ্ঠান। ইসলামী সংস্কৃতি বাস্তবায়নে এ প্রতিষ্ঠানের আরো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের কয়েকটি প্রস্তাবনা হলো-
* সরকারী উদ্যোগে ইসলামী টেলিভিশিন ও বেতার চ্যানেল প্রতিষ্ঠা;
* সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চালু করা;
* দেশের চলমান টেলিভিশন ও বেতারগুলোকে ইসলামাইজেশন করার উদ্যোগ গ্রহণ;
* এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন ইসলামী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী গঠন।
পরিবার প্রথা ও পারিবারিক বন্ধন সদৃঢ়করণ : আধুনিক সমাজ যান্ত্রিক উন্নতিকে আত্মস্থ করতে গিয়ে নৈতিকতাকে সম্পর্ণ উপেক্ষা করছে। পশ্চাত্যের অধিকাংশ মানুষ ‘খরারহম ঃড়মবঃযবৎ’ পন্থাকে ‘গধৎৎরধমব’ এর বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে। যা দেখে আমাদের কোমলমতী তরুণ-তরুণীরা ইভটিজিং-এ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। অথচ ইসলাম অভিভাবকদের নির্দেশ দিয়েছে পরিণত বয়সে ছেলে মেয়েদেরকে বিয়ের ব্যবস্থা করতে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও। “আল-কোরআন, ২৪: ৩২”
আলক্বামাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করতে সক্ষম, তারা যেন বিবাহ করে নেয়। আর যে ব্যক্তি বিবাহ করতে অক্ষম, সে যেন রোজা রাখে। কেননা, রোজা তার যৌন ক্ষুধাকে অবদমিত রাখে। ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৫০৬৫”
চারিত্রিক উন্নতি সাধন : মূলত চারিত্রিক অবক্ষয়ের করণেই সমাজে ইভটিজিং এর ন্যায় ভয়াল সামাজিক অপরাধ নেমে এসেছে। তাই ইভটিজিং প্রতিরোধে যে কাজটি সবার আগে করতে হবে তা হলো- ব্যক্তি চারিত্রের উন্নতি সাধন। ইসলামী জীবনাদর্শে চারিত্রিক উন্নতি সাধন একটি মহৎ গুণ। নবী মুহাম্মদ (সা.) চারিত্রিক উন্নতির পূর্ণতা সাধন করতেই এ পৃথিবীতে আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহান নৈতিক গুণাবলী পবিপূর্ণ করার জন্যই আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। “আবু মুহাম্মদ আব্দল্লাহ বিন ওয়াহাব বিন মুসলিম, আল জামে, মিশর: দারে মাকতাবা হাসান হুসাইন, ১৪৬১., হাদসি নং-৪৮৩”
নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত জাতি গঠন : মানুষ নৈতিক জীব। নৈতিক জীবনবোধ মানুষকে ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, নীতি-দুর্নীতি, পাপ-পুণ্য সম্পর্কে সচেতন করে, প্রেরণা যোগায়, ভালো হতে সাহয্য করে। ধর্মই নৈতিকতার “নৈতিকতার ইংরেজী প্রতিশব্দ গড়ৎধষরঃু, যা এসেছে গড়ৎধষং থেকে। এর অর্থ হলো: আচর-ব্যবহার, রীতি-নীতি বা ঈঁংঃড়সং প্রথা। আরবী প্রতিশব্দ হচ্চে খুলুক বহুবচন (কযঁষয়) বহুবচন (অশযষধয়) আখলাক।” আসল ও প্রকৃত উৎস। ধর্মের বাঁধন শিথিল হয়ে গেলে কিংবা ধর্মের শিক্ষা ও নির্দেশনা ভুলে গেলেও মানুষ তার সামাজিক পরিমন্ডলের উচিত-অনুচিত বোধ থেকে নৈতিক অবস্থান তৈরী করে নেয়; যা সর্বাত্মক ও পরিপূর্ণ নয়। কেননা, আল্লাহ প্রদত্ত তথা স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রেরিত নীতিমালা ও বিশ্বাসই মানব জীবনের সার্বিক কল্যাণের চালিকাশক্তি। ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন মানব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ উন্নয়ন ও পরিত্রাণ সম্ভব নয়। এজন্যই সত্য ধর্মাশ্রিত নৈতিক শিক্ষা মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য। ইসলাম ধর্মই নৈতিকতা শিক্ষার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। সুতরাং একজন মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নৈতিকতার বিচারে যে ব্যক্তি উত্তম, মু’মিনদের মধ্যে সে ব্যক্তিই পূর্ণতম ঈমানের অধিকারী। “ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায়: আবওয়বুল রিদা, অনুচ্ছেদ: বাবু মা জাআ ফি হাক্কুল মিরআতি আলা জাওজিহা, মিশর: শিরকাতু মাকতাবাতু মাতবাআত মুসতফাি আল বালী আল হালী, ১৩৯৫ হি., হাদীস নং- ১১৬২”
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই মূলত সমাজে ইভটিজিং-এর ন্যায় ভয়াল সামাজিক অপরাধ নেমে এসেছে। তাই জাতিকে এ নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে হলে যে কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে করতে হবে, তা হলো- জাতিকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলতে হবে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) জাতিকে নৈতিক শিক্ষায় সুন্দররূপে গড়ে তোলতেই এ পৃথিবীতে মহান শিক্ষকরূপে আগমন করেছিলেন।
মাদকাসক্তি দূরীকরণ : মাদকাসক্তি মানব বিবেক-বুদ্ধি ও মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক ও ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। মস্তিষ্কের করটেক্স বা উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির স্তর নিস্তেজ হয়ে যায় ফলে মদপানকারী মাতাল হয়ে পড়ে। লজ্জা-সংকোচ কমে যায়, কথাবার্তা বেশি বলে, এমনকি অনেক গোপন তথ্যও বের হয়ে পড়ে। কথাবার্তা জড়িয়ে যায়, এক পর্যায়ে চেতনা হারায়। মাদকাসক্তি মানুষকে শুধু মানবাত ও নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপের দিকেই উদ্বুদ্ধ করে না, এটা মানুষকে যাবতীয় মন্দ ও ঘণ্যতর পাপ কাজের দিকেও ধাবিত করে। এটা মানুষকে চিত্তবিভ্রাম, অস্থির ও উচ্ছৃঙ্খল করে তোলে। ব্যভিচার, নরহত্যা ছিনতাই, রাহাজানি, সড়ক দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের মত জঘন্যতম অপরাধের অধিকাংশই মাদকাসক্তিরই পরিণাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “মদ সকল অপকর্মের জননী।” “ইমাম দারাকুতনী, আল-সুনান, অধ্যায়: আল-আসরিবাতি ওগাইরিহা, বৈরুত: মুআস্সাসাতুর রিসালাহ,১৪২৪ হি., হাদীস নং- ৪৬১৩”
সুতরাং ইভটিজিং প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই সমাজ থেকে মাদকাসক্তি দূর করতে হবে।
ফলাফলমূলক পর্যালোচনা : ধর্ম বাংলাদেশের সমাজের চালিকাশক্তি, তাই ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে এদেশ থেকে ইভটিজিং এর প্রতিরোধ সম্ভব। আমরা উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, ইসলামী অনুশাসনের মাধ্যমেই ইভটিজিং প্রতিরোধ সম্ভব। এছাড়া ইদানীং কালে পত্রপত্রিকায়ও এ ব্যাপাওে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। “ইভটিজিং প্রতিরোধে প্রয়োজন ইসলামী অনুশাসন” এমন আলোচ্য ধারার আলোচিত কয়েকটি পত্রিকার নিবন্ধ হলো-দৈনিক প্রথম আলো, ২৮/১০/২০১০ শাস্তি হয় না উত্ত্যক্তকারীদের; দৈনিক নয়া দিগন্ত, ইভটিজিং বন্ধে আমাদের দায়িত্ব; দৈনিক নয়া দিগন্ত, ইভটিজিং নৈতিক অধঃপতনই মূল কারণ; দৈনিক নয়া দিগন্ত ইভটিজিং; আপন পাগল বেঁধে রাখি; দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯/১০/২০১০, গুরুতর সামাজিক সমস্যা ইভটিজিং প্রতিরোধে ধর্মীয় শিক্ষা; দৈনিক নয়া দিগন্ত, হঠাৎ নারী নির্যাতন মহামারীর কারণ; ইত্যাদি।” ইভটিজিং এর শিকার অধিকাংশ নারীর মতামত হলো, ইভটিজিং প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন-প্রয়োগের পাশাপাশি ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়ন জরুরী। “সারণি- ৫ দেখুন।”
সুপারিশসমূহ ঃ ইভটিজিং প্রতিরোধে আইনী ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি সুপারিশ হলো-
* আইন মন্ত্রণালয় ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘ ইভটিজিং প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন; অথবা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০)’ এর সংশোধন করে ‘ ইভটিজিং প্রতিরোধে ইসলামের অনুশাসন’ বিষয়ক ধারা সংযোজন;
* তথ্য মন্ত্রণালয় ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ‘ ইভটিজিং প্রতিরোধে ইসলামী অনুশাসন’ ধারণাটি ব্যাপকভাবে প্রচারকরণ;
* শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষার সর্বস্তরে ‘ ইভটিজিং প্রতিরোধে ইসলামী অনুশাসন’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্তকরণ;
* জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, পরিবারের প্রধান ব্যক্তিরা নিজ নিজ স্থান থেকে ‘ ইভটিজিং প্রতিরোধে ইসলামী অনুশাসন’ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ;
* অবাধ নারী স্বাধীনতায় গা ভাসিয়ে না দিয়ে নারী স্বাধীনতার মূল প্রত্যয় উপলব্ধি করে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলা;
* ইসলামী ভাবধারা অক্ষুণœ রেখে শিক্ষাব্যবস্থা ও নারীর কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ;
* ইসলামে প্রদর্শিত ‘মানহানি প্রতিরোধ’ আইন মেনে চলা;
* পারিবারিক শৃংখলা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় আইনের বাধ্যবাধকতা ও ইসলামী অনুশাসন গ্রহণে যতœশীল হওয়া;
* নারীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর মানসিকতা সৃষ্টি;
* চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনে তৎপরতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
উপসংহার : আল্লাহ তাআলা নারীকে মা, স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে সম্মান দিয়েছেন। অথচ আজ তারা আল্লাহর প্রদত্ত গৌরব ও মর্যাদা ভুলে গিয়ে মেকি ভোগ বিলাস, কামনা-বাসনা, অনৈসলামিক উম্মাদনায় আক্রান্ত। তারা আজ আদর্শ মা ও স্ত্রী হবার পরিবর্তে উচ্ছৃঙ্খল প্রেমিকা, রক্ষিতা, নায়িকা, মডেল ও খ্যাতি আর্জনে উদ্গ্রীব। উচ্ছৃঙ্খল, আঁটসাঁট পোশাক আর বেপরোয়া চলন-বলন অব্যাহত রেখে আইন প্রণয়ন অনর্থক। তাই আজকের সমাজ থেকে ইভটিজিং নামক কালো অধ্যায় দূর করতে হলে ইসলামী অনুশাসনের যথাযথ বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট। (সমাপ্ত)