সিলেটের শত বছরের সাংবাদিকতার স্মারক প্রতিষ্ঠান সিলেট প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সংস্কার, জাতীয় ঐক্য ও ভাবনা বিষয়ক এক নাগরিক সংলাপ শনিবার রিকাবিবাজারস্থ কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বলেছেন, সংস্কার বিষয়ে সবাই সবজায়গায় একমত নাও হতে পারে। আমি মনে করি, আমরা যদি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে কিছু বিষয়ে ঐক্যমত্য প্রয়োজন। তিনি বলেন, দেশ প্রেমকে প্রথমে নিজের করতে হবে। কারণ আমাদের অনেকের মধ্যে দেশ প্রেমের চেয়ে নিজের প্রেম, গোষ্ঠী প্রেম অনেক বেশি। আমরা রাজনৈতিকভাবে যে যে দলের ভক্ত, সেই বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছি দেশকে পিছনে ফেলে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা বেশিদিন হয়নি, ৬ মাস হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ১৫০ টিরও বেশি আন্দোলন হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছেন সবাই সবারটা নিয়ে ব্যস্ত, সবাই ভাবছে এই হচ্ছে একমাত্র সুযোগ। এই যে চিন্তা ভাবনা এটা থেকেই এতসব আন্দোলন। এই আন্দোলন কমছে না, বরং বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি ও দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহযোগিতায় আয়োজিত সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. কামাল আহমদ চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি ইকরামুল কবির ও সঞ্চালনায় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। শুরুতেই ছাত্র-জনতার অভ‚্যত্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত সিলেট প্রেসক্লাবের সদস্য শহীদ আবু তুরাবের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি আরও বলেন, শ্বেতপত্র কমিটিতে যখন কাজ করলাম, তখন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমন কোনো ব্যক্তিকে পাইনি যিনি বলেছেন দুর্নীতির জন্য আমি দায়ী। সবাই শুধু বলে উপরের তারা দায়ী। সুতরাং কেউ নিজেকে দায়ী করতে রাজী না। ভালো ভোট হলেও দেশের ভালো হবে না, দেশ অগ্রসর হবে না। ভালো ভোটের পরও দেশের অবস্থা খারাপ হয়েছে। এজন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে সংস্কার করতে হবে। শর্ট টাইম নিয়ে সংস্কার করতে পারবেন না। ভালোভাবে সংস্কার করতে হবে। শুধুমাত্র উন্নয়ন বাজেটে গত ২০১০ থেকে ২০২৩-২৪ সেশনে খরচ হয়েছে ১৭ লক্ষ কোটি টাকা। এই টাকা কোথাও না কোথাও তো গেছে। এই টাকা শুধু সরকারি রাজনীতিবিদের কাছেই যায়নি। এতে সরকারি আমলাদের ভাগ আরো বেশি। আমরা ভালো মানুষ হতে পারছি না, এটার কোনো সংস্কার হচ্ছে না। এটার সংস্কার আগে করতে হবে। সংস্কারের দায়িত্ব শুধু ইউনূস সরকারকে নিলে হবে না। প্রত্যেকেই নিজেদের সংস্কারের দায়িত্ব নিতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান অতিথি বলেন, আমাদের প্রথম চিন্তা হওয়া উচিত দেশাত্মবোধ, ন্যায়বোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সমাজের জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে। আইন পরিবর্তন করতে হয় মানুষের আচরণে। মানুষের আচরণ বদলায়, আইনও পরিবর্তন করা দরকার। দিনদিন সমস্যা বাড়ছে। এত সংস্কার এক সরকারের পক্ষে সম্ভব না। সুতরাং আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত কতগুলো ন্যূনতম বিষয়ে। সেখানে আমরা কাজ করবো দেশ হিসেবে, জাতি হিসেবে।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. কামাল আহমদ চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের রাজনৈতিক ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ‚্যত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। পরবর্তীতে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গঠিত হয়েছে সংস্কার কমিশন।
এ প্রসঙ্গে তিনি প্রখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের কথা তুলে ধরে বলেন, আড়াই হাজার বছর আগে তরুণদের কাছে সত্য কথা না বলতে পারার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এদেশের ছাত্র জনতাও মৃত্যুকে বরণ করে ফ্যাসিবাদকে বিতাড়ন করেছেন। এখন এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচাািলত করতে অনেকগুলো সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
ড. কামাল আহমদ চৌধুরী বলেন, আমাদের সংবিধান থাকলেও কখনও সংবিধান অনুযায়ি শাসিত হয়নি। ৫৬ সালের আগে সংবিধান ছিল না। হোসেন সোরওয়ার্দি সংবিধান দিলে আইয়ূব খান সেই সংবিধান স্থগিত করেন। ১৯৭২ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হলে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ৭৩ সালে সংবিধানের মূলে আঘাত হানা হয়। ২০০৯ সালে নতুন করে সংবিধান পরিশোধিত করা হলে সেখান থেকে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়।
নাগরিক সংলাপে অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রকে পূণরুদ্ধারে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা সফলতা লাভ করে। সকলের প্রচেষ্টায় ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এই সরকারের ওপর মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সংস্কারের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে যা হবে দীর্ঘ কাংক্সিক্ষত। পতিত সৈরাচারের অনেক দোসর অন্তর্বর্তী সরকারে থেকে সরকারের ক্ষতি করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংলাপে মহানগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, বিগত সংসদে দেখেছি যারা দেখেও রিডিং পড়তে পারে না এবং যারা বাজারে বাজারে গিয়ে গান বাজনা করেছে তারাও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এগুলোর জন্যও সংস্কার ও আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। আইনের সুশাসনের জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল একজন জাতির পিতা। তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথাও সংবিধানে উল্লেখ করা হয়। এসবের জন্যই সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
লিডিং ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. বশির আহমদ ভ‚ইয়া বলেন, বিডিআর হত্যা, হেফাজত হত্যা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে হত্যা একই সূত্রে গাথা। দেশে সুবিধাভোগিরা ভাল অবস্থানেই থাকছে। এসব হত্যাকান্ডের বিচার না হলে দেশের অবস্থা আরো খারাপ হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, ছাত্র জনতার অভ‚্যত্থানে আহতরা ৬ মাস পরও সুচিকিৎসা পাচ্ছে না এটা বড় দুঃখজনক।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফয়েজ হাসান ফেরদৌস বলেন, দেশের উন্নয়নে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সকল বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তরের দাবি জানান।
আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হাসান, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি সিলেটের উপ-পরিচালক শাহ মো. নজরুল ইসলাম, সিলেট প্রেসবিটারিয়ান চার্চের সভাপতি ডিকন নিঝুম সাংমা, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক জোটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ফরিদ আহমদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দেলোয়ার হোসেন শিশির, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফয়েজ আহমদ, উইমেন ফর ইউমেন রাইটসের সভাপতি সামিয়া বেগম চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ মোস্তাক আহমদের ভাই সোহেল আহমদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বদর, মুহাম্মদ আমজাদ হোসাইন, আতাউর রহমান আতা, হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী ও এম এ হান্নান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সমরেন্দ্র বিশ^াস সমর, সিনিয়র সদস্য আব্দুল মালিক জাকা, সহ-সাধারণ সম্পাদক শুয়াইবুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ আনিস রহমান, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সম্পাদক শেখ আব্দুল মজিদ, পাঠাগার ও প্রকাশনা সম্পাদক কবির আহমদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক কোষাধ্যক্ষ কবীর আহমদ সোহেল, সাবেক দপ্তর সম্পাদক কামকামুর রাজ্জাক রুনু, সাবেক ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সম্পাদক জিয়াউস-শামস-শাহীন ও নূর আহমদ, সাবেক পাঠাগার ও প্রকাশনা সম্পাদক খালেদ আহমদ, সদস্য চৌধুরী দেলওয়ার হোসেন জিলন, মো. মুহিবুর রহমান, মো. ফয়ছল আলম, মো. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী এহিয়া, আশকার ইবনে আমিন লস্কর রাব্বী, নাজমুল কবীর পাভেল, সজল ছত্রী, দিগেন সিংহ, সিন্টু রঞ্জন চন্দ, নৌসাদ আহমেদ চৌধুরী, মানাউবী সিংহ শুভ, আব্দুল আউয়াল চৌধুরী শিপার, শফিক আহমদ শফি, সাকিব আহমদ মিঠু, সহযোগী সদস্য হুমায়ুন কবির লিটন ও এইচ এম শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।