কাজির বাজার ডেস্ক
চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের হাতে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে তার প্রথম জানাজা হয়। পরে সাইফুলের মরদেহ নগরের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠে নেওয়া হয়। সেখানে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির আলহাজ শাহজাহান চৌধুরীর ইমামতিতে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হাসান আরিফ।
জানাজায় উপস্থিত ছিলেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ, খান তালাত মাহমুদ রাফি, কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা মাওলানা শাহজাহান, বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী, এরশাদ উল্লাহ, সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন প্রমুখ। জানাজার আগে সমন্বয়ক আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তব্য দেন। তারা সাইফুলের হত্যাকারীদের দ্রæত গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করার দাবি জানান।
এদিকে ইসকন নিষিদ্ধ চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন আইনজীবী মনিরুজ্জামান। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের মতামত জানতে জরুরি ভিত্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে আদালতে ডেকে পাঠানো হয়।
বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের হাইকোর্ট বেঞ্চে পত্রিকাসহ আবেদন করেন মনিরুজ্জামান। যেখানে মঙ্গলবারের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। আদালতে এসে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সারাদেশের মানুষের মত তারও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয় এখনই কোনো সিদ্ধান্ত যেনো আদালত না নেয়। কারণ সরকার এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। সরকারের কাছে এটি এখন ১ নম্বর এজেন্ডা। এ সময় হাইকোর্ট বলেন, এরা কারা? এদের পরিচয় কী?
আদালত আরও বলেন, চট্টগ্রাম-রংপুরে এসব কী শুরু হয়েছে? এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
পরে হাইকোর্ট বলেন, বিকেলের মধ্যে আমাদের বিস্তারিত জানান। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমাকে একটা দিন সময় দিন। আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) এ বিষয়ে জানাবো, আজকের (গতকাল) মধ্যে সম্ভব হবে না।
পরে হাইকোর্ট বলেন ঠিক আছে কালকের মধ্যে একটা প্রতিবেদন দেন। তবে কোনো ভাবেই যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনকারীদের হামলায় নিহত হন সাইফুল ইসলাম আলিফ।
মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীরা চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা শুরু করলে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ তাদের বাধা দেন। এরপর তাকে তুলে নিয়ে আদালতের প্রধান ফটকের বিপরীতে রঙ্গম টাওয়ারের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সাইফুলকে কুপিয়ে আহত করে ইসকন সদস্যরা। গুরুতর আহত অবস্থায় সাইফুলকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসকনকে নিষিদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামকে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল। বুধাবার (২৭ নভেম্বর) ১০ আইনজীবীর পক্ষে তিনি এ নোটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর ডাকযোগে পাঠান।
নোটিশ পাঠানো আইনজীবীরা হলেন- মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ, নিজাম উদ্দিন, আব্দুল হান্নান ভ‚ঞাঁ হৃদয়, তৌহিদুল ইসলাম শান্ত, আতিকুল ইসলাম, মাসুম বিল্লাহ, রাসেল মাহমুদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাহফুজুর রহমান ও আল মোমেন।
এতে বলা হয়, ‘ইসকন একটি উগ্রপন্থী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই সংগঠনের প্রধান কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে উসকানিমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা, যার উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি। (বই- বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধানদের কথা- বাংলাদেশে ‘র’ পৃষ্ঠা:১৭১)। এ সংগঠনটি হিন্দুদের অধিকাংশ বেসিক কনসেপ্ট স্বীকার করে না। তারা হিন্দুদের ওপর সম্পূর্ণ নিজস্ব কনসেপ্ট চাপিয়ে দেয়। এরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দলে ভিড়িয়ে দল ভারি করে। সনাতন মন্দিরগুলো দখল করা এবং সনাতনদের মেরে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়া। বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে সাম্প্রদায়িক হামলা করা। কিছুদিন আগে ঢাকার স্বামীবাগে মসজিদের তারাবির নামাজ বন্ধ করে দিয়েছিল ইসকন। নামাজের সময় ইসকনের গান-বাজনা বন্ধ রাখতে বলায়Ñ তারা পুলিশ ডেকে এনে তারাবির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে বিষয়টি নিয়ে সংঘর্ষ হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংগঠন তৈরি করে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিস্তৃতি ঘটানো।’
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায় যে, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর থেকে দেশে বিভিন্নভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির পেছনেও সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। সংগঠনটি বাংলাদেশে ইতোপূর্বে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, যেমন- ২০০৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রশিক রায় জিউ মন্দিরে দুর্গাপূজা নিয়ে ইসকনপন্থী ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় ইসকনভক্তদের হামলায় ফুলবাবু নামে একজন নিহত হন। ফলে ১৪ অক্টোবর ২০১৮ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের রায় জিউ মন্দিরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। ২০২১ সালের ১৪ মার্চ ইসকন মন্দির থেকে সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রবর্তক সংঘের কর্মচারীদের ওপর হামলা চালায় এতে ১২ জন আহত হয়। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের ইসকন মন্দির থেকে বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের ভিডিও ফাঁস হয়, ইসকন মন্দিরে ধর্ম পালনের নামে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি অস্ত্র রাখে। গোপালগঞ্জে ইসকনের মিছিল থেকে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালায় ও গুলি ছোড়ে। চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর ইসকন সমর্থকদের হামলা ও এসিড নিক্ষেপ, যৌথ বাহিনীর ১২ সদস্য আহত হন (২০০৪ সালের নভেম্বর)।’
নোটিশে ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবি তুলে আরও বলা হয়, ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ১৮ ধারার বিধান মতে, কোনো ব্যক্তি বা স্বত্বা কোনো সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করে ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। ইসকন নামে উগ্রপন্থী সংগঠনের বিগত ও বর্তমান সময়ের কার্যক্রমগুলোকে অত্র আইনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সংঙ্গার মধ্যে পড়ে বিধায় অত্র আইনের বিধান মোতাবেক অত্র সংঘঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়া একান্ত আবশ্যক বটে।’
যৌথবাহিনীর অভিযানে আটক ২৭ : চট্টগ্রামের তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার সঙ্গে জড়িত অন্তত ২৭ জনকে আটক করেছে যৌথবাহিনী। কোতোয়ালি থানার ওসি ফজলুল কাদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আটক ২৭ জনের বিষয়ে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার রইছ উদ্দিন। সিএমপির এই কর্মকর্তা জানান, ‘অভিযানে আটককৃতদের কার ভ‚মিকা কী ছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এখনও কোনো মামলা দায়ের হয়নি। ‘ এ ঘটনায় বন্দরনগরীতে দেশীয় ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ (ককটেল)সহ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ছয় সদস্যকে আটক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নগরীর পাথরঘাটা মাথার পট্টি, আন্দরকিল্লা, হাজারী গলি এলাকা অভিযান চালিয়ে যৌথবাহিনী তাদের আটক করেছে। চট্টগ্রামে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর হওয়াকে কেন্দ্র করে তার সমর্থক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিক্ষুব্ধ জনতার ত্রিমুখী সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে একটি গলির মধ্যে নিয়ে কু পিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
এদিকে দিনভর সংঘর্ষের ঘটনায় রাত ১০টার পর থেকে নগরজুড়ে চলেছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। তবে রাতে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার বিষয়ে কোনো মামলা হয়নি বলে জানায় পুলিশ। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নাজিম উদ্দিন জানান, বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় নিহত আইনজীবী সাইফুলের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর সকাল ১০টায় আদালত প্রাঙ্গণে তার প্রথম নামাজে জানাজ অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে বুধবার ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর চট্টগ্রাম আদালতের জামিন শুনানির কথা থাকলেও তরুণ আইনজীবী সাইফুল হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আদালত বর্জনের ডাক দিয়েছে জেলা আইনজীবী সমিতি।