শেখ একেএম জাকারিয়া
শীতের পিঠা বাঙালির আদি খাদ্যকৃষ্টির সুবৃহৎ অংশ। বাংলাদেশের বাংলাভাষী অধিবাসীর খাদ্যসংস্কৃতিতে ভাত ও রুটির পরে যে খাবারটি সর্বাপেক্ষা বেশি লোকপ্রিয়, যে খাবার ভিন্ন লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা ভাবাই যায় না, যে খাবার নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে সংখ্যাতীত কবিতা-ছড়া-লোকগান-গল্প, যে খাবার নিয়ে এখনও বাঙালির প্রতিটি ঘরে নিয়মিত আলোচনা হয়, তা হলো পিঠা। কোথায় নেই পিঠা? জ্ঞাতি-কুটুম্ব বা আগন্তুক বাড়িতে এলে পিঠা, নবান্ন উৎসবে পিঠা, বিয়ে বাড়িতে পিঠা, ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আজহাতে পিঠা, পূজো পার্বণ ও পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠা। মোটকথা সবখানেই আছে পিঠার মনোমুগ্ধকর আমেজ। বছরজুড়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন আনন্দনুষ্ঠানে পিঠা খাওয়ার বা তৈরির রেওয়াজ থাকলেও মহাসমারোহ পিঠা তৈরি বা খাওয়ার যথার্থ সময় হচ্ছে শীতকাল। শীত এলেই বাংলার মানুষজন চিরপ্রচলিত পিঠা উৎসবে মেতে ওঠে। এসময় তৈরি করা হয় বাহারি রকমের পিঠা। মানুষজনের কাছে যেসব পিঠার কদর খুব বেশি থাকে। শীতঋতুকে অনেকেই পিঠা তৈরির প্রধান উৎসবও বলে থাকেন।
শীতের পিঠা সাধারণত চালের গুঁড়ো, গুড়, ডালবাটা, নারকেল প্রভৃতি সহযোগে প্রস্তুত মিঠাইবিশেষ। এদেশে বহুকাল যাবত প্রচলিত লোকজ খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠা একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। পৌষ-মাঘের শীতল বায়ু ব্যতিরেকে যেমন শীতকে অনুভব করা যায় না, ঠিক তেমনি পিঠা ব্যতিরেকে বাঙালির পরম্পরাগত চিন্তা, সংস্কার,ভাবধারা,অভ্যাস প্রভৃতি ভাবাই যায় না। শীত মৌসুম এলে দেশব্যাপী পিঠা তৈরির ব্যস্ততা নজরে পড়ে। অধিকন্তু এসময় পল্লী বাংলার প্রতিটা বাড়িতে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণে মা-বোন-বউঝিরা চুলার পাশে বসে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। এসময় শিশু-কিশোরসহ বাড়ির অন্যান্যরা গরম গরম পিঠার স্বাদ গ্রহণ করেন। এসব পিঠা বানানো হয় একেক অঞ্চলে একেক রকম পদ্ধতিতে।
এলাকা ভিত্তিক নানারকমের পিঠা যেমন দেখা যায়, তেমনি একেকটি পিঠার নানারকমের নামও লক্ষ্য করা যায়। আবার অঞ্চলভেদে একই পিঠা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। যেমন, তেল পিঠাকে কোনও কোনও এলাকায় পাকান পিঠা বা হান্দেশ বলা হয়। আমাদের দেশে পিঠা তৈরির রান্নাপদ্ধতি দু ধরনেরভাজা ও ভাপা। ভাপে বা তাপে সিদ্ধ করা হয়েছে এমন পিঠাকে ভাপা পিঠা বলা হয়। আর ভাজা পিঠা হচ্ছে গরম ঘি, ডালডা বা তেলে রাঁধা হয়েছে এমন পিঠা। এই ভাপা ও ভাজা পিঠা কখনও দুধে চুবিয়ে দুধপিঠা আবার কখনও চিনি বা গুড়া মেশানো পানি ফুটিয়ে তৈরি রস বা খেজুরের রসে চুবিয়ে রসের পিঠা তৈরি করা হয়। আর নকশি পিঠা নকশা আঁকা চমকপ্রদ অর্থাৎ চমক জাগায় এমন ভাজা পিঠা। এটিকে দুধ, খেজুরের রস, চিনি বা গুড় মেশানো ফুটানো পানিতে চুবিয়ে অথবা শুকনো অবস্থায়ও খাওয়া যায়। তাছাড়া শীতকালে সকালবেলা অথবা সাঁঝের বেলা গ্রামের বাজারে, শহরের ফুটপাতে, পাড়ার ভেতরে অলিগলিতে পিঠাওয়ালাদের দেখা মিলে। তারা মূলত তেলের পিঠা, চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠাই বিক্রি করে। বাংলাদেশে বেশি প্রচলিত পিঠার মধ্যে রয়েছে ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ডিম চিতই পিঠা, দোল পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পাকান পিঠা, কাটা পিঠা, ছিটা পিঠা, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চাঁদ পাকান পিঠা, পুলি পিঠে, আন্দশা, পাতা পিঠা, পানতোয়া, মালপোয়া, মেরা পিঠা, মালাই, কুশলি, ক্ষীরকুলি, চন্দ্রপুলি, গোলাপ ফুল, লবঙ্গ লতিকা, ঝালপোয়া, সূর্যমুখী, নারকেলি, দুধরাজ ইত্যাদি।
সর্বোপরি আমাদের দেশে কত রকমের পিঠা যে তৈরি হয়, তার ঠিক পরিমাণ বা সংখ্যা কারও জানা নেই। তবে কিছু পিঠা আছে যা সমগ্র বাংলাদেশেই তৈরি হয় বা পাওয়া যায়। আবার কিছু পিঠা যে এলাকায় বা অঞ্চলে তৈরি হয় সে এলাকার বাইরে তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না। যেমন, সিলেটের চুঙ্গি পিঠা, বিক্রমপুরের বিবিখান পিঠা ইত্যাদি। উল্লিখিত পিঠাসমূহ এলাকাভিত্তিক শহরের দোকানে অল্প পরিমাণে পাওয়া গেলেও গ্রামাঞ্চলে এখন আর আগের মতো খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না।
কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসছে এসব পিঠা। এর কারণ মূলত পিঠা তৈরিতে পর্যাপ্ত উপকরণের অভাব এবং নারীরা ঘরের বাহিরে কর্মমুখী হওয়ায় পিঠা তৈরিতে সময় দিতে না পারা। তবে এটা সত্য যে, পিঠাকে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত রাখার পুরো নিপুণতা কিন্তু নারীদের। শতশত বছর ধরে চলে আসা লোকপ্রিয় এসব খাবারে এসেছে অনেক রূপান্তর। এ সময়ে আমাদের পিঠা খাওয়ার খুব আকাক্সক্ষা হলে নিজেরা তৈরি না করে ছুটে যাই পিঠার দোকানে। কিন্তু আমরা যদি একটু পরিশ্রম করে নিজের ঘরে পিঠা তৈরি করে পিঠার স্বাদগ্রহণ করি, তার পুলক হবে সবচেয়ে বেশি।