সিন্টু রঞ্জন চন্দ
সিলেটে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী রুদ্র সেন এবং সাংবাদিক এ টি এম তুরাব নিহতের ঘটনায় পৃথকভাবে দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আব্দুল মোমেনের আদালতে এই মামলা দুটি দায়ের করা হয়।
রুদ্র সেন হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শাবিপ্রবির সমন্বয়ক হাফিজুল ইসলাম এবং
সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব (এ টি এম তুরাব) হত্যার ঘটনায় মামলাটি দায়ের করেছেন তাঁর ভাই আবুল আহছান মো. আযরফ (জাবুর)।
পৃথক দুটি মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সিলেটের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, শাবির সাবেক উপাচার্য, সিলেটের সাবেক ৩ এমপি, সিসিক কাউন্সিলর, সিলেট এসএমপির ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, শাবি ও সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ, জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ ৬৪৬ জনকে আসামী করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী রুদ্র সেন হত্যা মামলা: বৈষাম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন নিহতের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে সিলেটের অতিরিক্তি চিফ মেট্রোপলিটন আব্দুল মোমেনের আদালতে এই মামলটি দায়ের করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শাবিপ্রবি শাখার সমন্বয়ক হাফিজুল ইসলাম।
রুদ্র সেন মৃত্যুর ঘটনায় মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পদত্যাগী উপচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদ, প্রক্টর কামরুজামান চৌধুরী, সিলেট সিটি কর্পোরেশেনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সিলেট-৩ আসনের সাবেক সাংসদ হাবিবুর রহমান হাবিব, সুনামগঞ্জ ১ আসনের সাবেক সাংসদ রঞ্জিত সরকার, মৌলভীবাজার-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ ৭৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত নামা আরো ৩০০ জনকে আসামি করা হয়।
আদালতে জমা দেয়া এজাহার অনুসারে রুদ্র সেন হত্যা মামলার অপর আসামিরা হলেন- সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী, সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাদেক দস্তগীর কাউসার, জালালাবাদ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মিজানুর রহমান, পরির্দশক (তদন্ত) আবু খালেদ মো. মামুন, শাবিপ্রবির সাবেক প্রো-ভিসি কবির হোসেন, সাবেক প্রক্টর কামরুজ্জামান চৌধুরী, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ২০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, সহ-সভাপতি ও ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জগদীশ চন্দ্র দাস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আফতাব হোসেন খান, মহানগর যুবলীগ সভাপতি আলম খান মুক্তি, জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, সভাপতি নাজমুল ইসলাম, মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি কিশোয়ার জাহান সৌরভ, সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমদ, ৩২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, এসআই রেজওয়ান আহমদ, কনস্টেবল রনি চন্দ্র রায়, এসআই নহোরেন্দু তালুকদার, কনস্টেবল সুজিত সিংহ, অপূর্ব সিংহ, প্রণজিৎ, সুমন, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ সভাপতি খলিলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সজিবুর রহমান, সহ-সভাপতি মামুন শাহ, ফারহান রুবেল, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান স্বাধীন, সাইমন ইসলাম, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, সহ-সভাপতি তানিম খন্দকার, ছাত্রলীগ কর্মী দেলোয়ার হোসেন, শফিউল রাব্বী, সহ-সভাপতি রেজাউল হক সিজার, ইউসুফ হোসেন টিটু, মনসুর আলম নিরব, সাংগঠনিক সম্পাদক লোকমান হোসেন, আরকে রাকিব হোসেন, শুভ সাহা, সহ-সভাপতি আশিকুর রহমান আশিক, শাবিপ্রবি ছাত্র ফরহান হোসেন চৌধুরী আরিয়ান, সানি শেখ, ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ তারেক, সহ-সভাপতি শিমুল মিয়া, আয়াজ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত সাহা, ‘আমরা সাস্টিয়ান’ গুপের এডমিন আব্দুল কাদির মোহাম্মদ রেদোয়ান, নুরুল ইসলাম, ময়নুল ইসলাম, আহমদ সাজন, হাসান আহমদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য জাহিদ সরোয়ার সবুজ, সিসিকের ৩৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হেলাল উদ্দিন, শহীদ মু. অকিল অপু, মো. শাহজাহান, মু. আপ্তাব হোসেন সিরাজী, অহিদ উদ্দিন দুলাল, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি রশিদ আহমদ, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল লতিফ রিপন, মুজিবুর রহমান মালদার, আবু সুফিয়ান উজ্জ্বল, সিসিকের ১০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ, মাজহারুল ইসলাম সুমন, শাহনুর আলম, রুহিন আহসান খান, আমির হোসেন খানসহ অজ্ঞাত আরও ৩০০ জন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স (সিইপি) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। গত ১৮ জুলাই কেন্দ্রঘোষিত অবস্থান কর্মসূচি ছিল। সেদিন শাবিপ্রবির প্রধান ফটকের পাশে সুরমা আবাসিক এলাকায় পুলিশ ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা পরিকল্পিতভাবে সরকারি অস্ত্র, অবৈধ বন্দুক, রাইফেল, দা ও লাঠিসোঁটা নিয়ে শান্তিপ্রিয় ছাত্র-জনতাকে আক্রমণ করে। এতে অনেকে শারীরিকভাবে গুরুতর আহত হন। অস্ত্রধারীরা হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিও ছোড়ে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনার একপর্যায়ে আসামিদের ধাওয়া খেয়ে আহত অবস্থায় রুদ্র সেন সুরমা আবাসিক এলাকা ও বাগবাড়ী এতিম স্কুলের রাস্তার সংযোগস্থলে একটি খালে পড়ে যান। তাঁর সাঁতার না জানার বিষয়টি জেনেই আসামিরা পরিকল্পিতভাবে রুদ্রকে খালে ফেলে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
সাংবাদিক এটিএম তুরাব হত্যা মামলা: ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই সিলেটে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক এটিএম তুরাব। ঘটনার এক মাস পর নিহতের ভাই আবুল আহসান মো. আযরফ (জাবুর) বাদী হয়ে সোমবার সিলেট অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। বেলা ১১টায় দায়েরকৃত এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালকে। এজাহারে আসামি হিসেবে পুলিশসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে।
আদালতে জমা দেয়া এজাহার অনুসারে আসামিরা হলেন- ১নং আসামী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মামলায় ২ নম্বর আসামি অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ক্রাইম উত্তর) মো. সাদেক দস্তগীর কাউসার, ৩ নম্বর আসামি সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, ৪ নম্বর আসামি সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি) মিজানুর রহমান। অন্য আসামিরা হলেন- সিলেটের কোতোয়ালি মডেল থানাধীন বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ কল্লোল গোস্বামী, থানার সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈন উদ্দিন, পরিদর্শক (তদন্ত) ফজলুর রহমান, থানার এসআই কাজি রিপন সরকার, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সিসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আফতাব উদ্দিন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি পিযূষ কান্তি দে, সিলেট সিটি করপোরেশনের পিআরও সাজলু লস্কর, সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সিসিকের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, নগরের চালিবন্দর নেহার মঞ্জিলের বাসিন্দা শিবলু আহমদ (মো. রুহুল আমিন), এসএমপির কনস্টেবল সেলিম মিয়া, আজহার ও ফিরোজ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৯ জুলাই দুপুর ২টার দিকে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধি ও স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক এটিএম তুরাব সিলেট নগরীর মধুবন সুপার মার্কেটের সামনে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় আসামিরা টার্গেট করে শত শত গুলি ছুড়ে তুরাবকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন। এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মদদপুষ্ট আওয়ামী লীগ দুর্বৃত্তরা ও অবৈধ সরকারের অপেশাদার পুলিশ ও দুর্বৃত্ত দ্বারা ন্যাক্কারজনক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আসামিরা সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে একজোট হয়ে বাদীর নিরপরাধ ছোট ভাই সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাবকে (এটিএম তুরাব) হত্যা করা হয়। দিন দুপুরে শত শত মানুষের সামনে উক্ত হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে ২ থেকে ৫ নম্বর আসামি বাদীকে হত্যার হুমকি দেয়। পরে আসামিরা রাষ্ট্রীয় প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাদীকে ঢাকায় নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করান।
বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুর রব বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা আজবাহার আলীর নির্দেশে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. সাদেক দস্তগীর কাউসার গুলি ছুঁড়েন সাংবাদিক তুরাবকে লক্ষ্য করে। একই সাথে অভিযুক্ত অন্যরাও হত্যাকাÐের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় আসামি করা হয়েছে।