স্যোসাল মিডিয়ায় ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা

7

 

কাজির বাজার ডেস্ক

ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি বহুবছর ধরেই চলে আসছে। আগে বিষয়টি খুবই সুক্ষভাবে যেমন- কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বা ছোট ছোট পোস্টার ছাপিয়ে বিভিন্ন কায়দায় করা হতো। তবে প্রযুক্তির যুগে এসে এটি বেশ খোলাখুলি বিষয় হয়ে গেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক শ্রেণির প্রতারক ভুয়া বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পুরাতন বিজ্ঞাপনকে কায়দা করে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে। আর এসব বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কিছু মানুষ।
দেশের অধিকাংশ মানুষ সহজ সরলভাবে জীবন যাপন করেন। আর কিছু অসাধু মানুষ এই মানুষগুলোকে টার্গেট করে চাকরির বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির ভুয়া বিজ্ঞাপন অনলাইনে প্রচার করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
আসা যাক চাকরির ভুয়া বিজ্ঞাপনের বিষয়ে। দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। তাছাড়া চাকরি করছেন কিন্তু আরও ভালো চাকরি পাওয়া আশায় থাকেন বিশাল একটা অংশ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েক বছর ধরেই ভুয়া নিয়োগের ফাঁদ পাতা হচ্ছে। আর এসব বিজ্ঞাপনের সত্যতা যাচাই না করে এই ফাঁদে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষ।
এটা যে শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির বিষয় তা নয়। এসব ক্ষেত্রে তথ্য চুরির আশঙ্কাও রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব সরকারি ও বেসরকারি চার ধরণের প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া নিয়োগ সংক্রান্ত অভিনব প্রতারণার সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ নামে একটি ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান। যাদের প্রধান লক্ষ্য দেশের চলমান গুজব ও ভুয়া খবর নির্মূল করা এবং সঠিক তথ্য বের করে আনা।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দেশের সাতটি সিটি কর্পোরেশন, ২০টি পৌরসভা, ৬০টি হাসপাতাল এবং অন্তত ২০টি পাসপোর্ট অফিসের নাম, লোগো ব্যবহার করে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির তথ্য। যারা ভুয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চাকরি প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত প্রথমে ইমেইল পাঠানোর অনুরোধ করে এবং পরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণার জাল পেতেছে।
আর এসব কথিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোকে বিশ্বস্ত করে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকার লোগো।
সাত সিটি কর্পোরেশনে ভুয়া নিয়োগের ফাঁদ খোঁজতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, চলতি বছর ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ এবং গাজীপুর বাদে বাকি সিটি কর্পোরেশনগুলো ভুয়া নিয়োগের ফাঁদে পড়েছে। এদের মধ্যে তারিখ বদলে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নামে দুইবার একই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রæয়ারির তারিখে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রথম ভুয়া বিজ্ঞপ্তি আসে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের। বিজ্ঞপ্তিতে এই কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, পরিচ্ছন্ন পরিদর্শন, ইপিআই সুপারভাইজার, হিসাবরক্ষক, সহকারী হিসাবরক্ষক এবং এমএলএসএস পদের জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। তবে, কোনো পদের বিপরীতেই সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে পদভেদে জেএসসি থেকে স্নাতক পর্যন্ত।
বিজ্ঞপ্তিতে ছয়টি শর্ত যুক্ত করা হয়। এর একটি শর্তে বলা হয়, প্রার্থীদের পাঠানো জীবন বৃত্তান্ত যাচাই বাছাই করার পর খুদে বার্তা বা এসএমএস পাঠানো হবে। এই এসএমএস পাওয়ার চার ঘন্টার মধ্যেই ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে।
বিষয়টি খেয়াল করলে দেখা যায়, সাধারণত কোনো সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ড্রাফটের জন্য এত কম সময় বেঁধে দেওয়া হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। আর জীবনবৃত্তান্ত পাঠাতে ব্যবাহার করা হয়েছে জিমেইল পরিসেবার ইমেইল (পরঃুপড়ৎঢ়ড়ৎধঃরড়হ১১০@মসধরষ.পড়স)।
রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, প্রথম আলোর গত ২৪ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রæয়ারির (আবেদনের শেষ তারিখ) প্রিন্ট সংস্করণ যাচাই করে এমন কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়নি। তাছাড়া খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সানজিদা বেগমও এমন কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন।
এরপর গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত আরও ছয়টি সিটি কর্পোরেশনের নামে একই কায়দায় সাতটি ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে ফেসবুক।
যদিও এসব ভুয়া বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রচারের পর সংশ্লিষ্ট একাধিক সিটি কর্পোরেশন সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনের ভুয়া নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিগুলোর ক্ষেত্রে ‘সিটি কর্পোরেশন’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। লকড অবস্থায় থাকা অ্যাকাউন্টটিতে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের লোগো দেওয়া আছে প্রোফাইল ছবিতে।
পর্যবেক্ষণে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, যখন যে সিটি কর্পোরেশনের নামে এই অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয় তখন সেই সিটি কর্পোরেশন বিষয়ক তথ্য অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়।
এসব বিজ্ঞপ্তি দেখে জীবন বৃত্তান্ত পাঠিয়েছেন এমন কয়েকজনের খোঁজ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জানতে পারে, রংপুর, বরিশাল এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া ইমেইল ভিন্ন হলেও এই ব্যক্তিদের একই নম্বর (০৯৬৩৮৭৬৩১৮৬) থেকে এসএমএস দেওয়া হয়েছে।
এসএমএসে ওই ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন জানিয়ে ৩০৫ টাকা ব্যাংক ড্রাফট করার জন্য আরেকটি মোবাইল নম্বর (+৮৮০১৬১২০৭৯৩১২) দেওয়া হয়েছে। তিন ব্যক্তিকেই এই নম্বরেই ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা নগদের মাধ্যমে ৩০৫ টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে।
পৌরসভার নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও একই ধাঁচে প্রতারণা করা হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে গাইবান্ধা এবং পটুয়াখালী পৌরসভার দুইটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। সিটি কর্পোরেশনগুলোর ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মতো এই দুই বিজ্ঞপ্তিতেও ‘প্রথম আলো’র লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। যথারীতি এই দুই বিজ্ঞপ্তিও পত্রিকাটির কোনো প্রিন্ট সংস্করণে পাওয়া যায়নি।
এই দুই বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তির নাম ও পদবী ভিন্ন থাকলেও স্বাক্ষর একই ছিল। গাইবান্ধা পৌরসভার ক্ষেত্রে জীবন বৃত্তান্ত পাঠাতে দেওয়া ইমেইল ঠিকানা ঢ়ড়ঁৎধংযধাধ৪৬৫সধুড়ৎ@মসধরষ.পড়স। পটুয়াখালী পৌরসভার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ঢ়ড়ঁৎধংযধাধ৩৬৫সধুড়ৎ@মসধরষ.পড়স এই ইমেইল ঠিকানা।
গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আরও অন্তত ১৮টি পৌরসভার নামে একই কায়দায় ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে ফেসবুকে।
সরকারি বেসরকারি হাসপাতালেও একই কায়দায় ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে ফেসবুকে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে গত ১৬ মে পর্যন্ত দেশের অন্তত ৩২টি জেলার অন্তত ২৬টি সরকারি ও ৩৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের নামে ভুয়া নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে।
চলতি বছর প্রচার হওয়া ৩০টি হাসপাতালের ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মধ্যে ২০টিই সরকারি প্রতিষ্ঠান।
রিউমর স্ক্যানার দুইটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টেরও সন্ধান পেয়েছে যারা গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে হাসপাতাল সম্পর্কিত এই ধরণের ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো বিভিন্ন ফেসবুক গ্রæপে নিয়মিত পোস্ট করে আসছেন। এর মধ্যে গফ ঐধনরন এবং অহমবষ আধ অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন গ্রæপে পোস্ট করার প্রমাণ মিলেছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর নাম ও লোগো ব্যবহার করে ‘ঐড়ংঢ়রঃধষ অঁঃযড়ৎরঃু’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একই কায়দায় ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে।
২০২২ সালে ২০টি জেলার পাসপোর্ট অফিসের নামেও ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের তথ্য পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। সে বছরের অন্তত এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এসব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে প্রচার করা হয়। এসব ক্ষেত্রে ৯টি ইমেইল ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।
২০২২ সালে চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসের নামে এ সংক্রান্ত ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের প্রেক্ষিতে এটিকে ভুয়া উল্লেখ করে চট্টগ্রামের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক এবং আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক ও ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক জানান, ‘পাসপোর্ট অফিসের নিয়োগ আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয় থেকে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। যেখানে নিয়োগের যাবতীয় তথ্যসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার নাম ও স্বাক্ষর থাকবে। তবে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টারটি তৈরি করা হয়েছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। ব্যবহার করা হয়েছে মোবাইলের ফ্রন্ট।’
আক্ষেপের বিষয় হলো, এসব সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে আসার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়েই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হলেও কোনো ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না এসব প্রতারণা।
ডিজিটাল জালিয়াতির ফাঁদে পা দিয়ে অনেক চাকরিপ্রত্যাশীই আর্থিক প্রতারণার পাশাপাশি ব্যক্তিগত অনেক তথ্যই প্রতারকদের হাতে দিয়ে দিচ্ছেন। এতে বø্যাকমেইল হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
এজন্য যে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নজরে আসার পর শুরুতেই এটি আসল কি-না তা যাচাই করে নেওয়া জরুরি।