শিক্ষা ব্যয়ের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি অভিভাবকদের সীমিত আয়ের ওপর চাপ তৈরি করছে ক্রমাগতভাবে। বিদ্যালয়ের বেতন, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং ও সহায়ক বই বাবদ শিক্ষা ব্যয় বেড়েই চলেছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এই তিন খাতে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেড়েছে। প্রাথমিকের তুলনায় মাধ্যমিক পর্যায়ে এই খরচের হার তুলনামূলক বেশি। শিক্ষা ব্যয় কমাতে শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ করতে সরকারের প্রতি দাবি অভিভাবক ঐক্য ফোরামের। অভিভাবকরা বলছেন, বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে তাদের পক্ষে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষাসামগ্রীর খরচ যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী তাদের আয় বাড়েনি। ফলে সংসারই চলছে না। বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ চালাবেন কীভাবে? অভিভাবকদের দাবি, শিক্ষা-উপকরণ যেন সরকার সরবরাহ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক ফি বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। কোচিং, প্রাইভেট বন্ধ করে বিদ্যালয়ে সব বিষয় যাতে পড়ানো হয়, সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। সম্প্রতি প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসের পারিবারিক শিক্ষা ব্যয় আগের বছরের (২০২২) তুলনায় প্রাথমিক স্তরে বার্ষিক ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় স্তরেই প্রধানত ব্যয় হয়েছে প্রাইভেট টিউটরের বেতন ও গাইড বই বা নোট বই বাবদ। তথ্য বলছে, এ বছর শিক্ষা-উপকরণের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। তবে গত বছর তিন থেকে চার দফায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে নোট বই বা সহায়ক বইয়ের দাম গত বছরের তুলনায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসডিজির নীতিমালায় আছে- দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে শিক্ষা। বাংলাদেশ তাতে স্বাক্ষর করেছে। অন্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করা গেলে শিক্ষা ব্যয় কিছুটা কমবে। একই সঙ্গে উপবৃত্তি বাড়ানো এবং মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করতে হবে। এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেছেন, ২০২২ সালে ইউনেসকোর রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যয়ের ৭১ শতাংশ বহন করে পরিবার। এই শিক্ষার খরচ দিন দিন বাড়ছে। সরকার নীতিগতভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালুর চিন্তা করা হচ্ছে। যেটা এখন মূলধারার প্রাথমিকে আছে। সেটা মাধ্যমিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ছেলেমেয়েরা কোচিংয়ে যায় না। এটা আমাদের দেশে বেশি দেখি। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার যে নিয়ম করে গিয়েছিলেন, সেখানে ছিল জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষকদের বেতন এখনো নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। কোচিং বাণিজ্য, গাইড বই বাণিজ্য বন্ধ করা উচিত। এগুলোর জন্যই ব্যয় বেড়ে যায় অভিভাবকদের। সরকারের উচিত শিক্ষাব্যবস্থায় যাতে কোনো সিন্ডিকেট না থাকে সেই পদক্ষেপ নেওয়া।’
এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষাদানের জন্য যোগ্য শিক্ষক দরকার। যা এ দেশে গড়ে ওঠেনি। শিক্ষকদের যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষানীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হচ্ছে। রূপান্তরিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষক এবং ছাত্রদের একটি মেলবন্ধন তৈরি করতে না পারলে এই শিক্ষাব্যবস্থায় সফলতা আসবে না। দিনে দিনে এ দেশে যেভাবে শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে তা কমিয়ে আনতে সরকারকে কার্যকর ভ‚মিকা নিতে হবে। শিক্ষা-উপকরণ যাতে সবার সামর্থ্যরে মধ্যে থাকে সেই ব্যবস্থা রাখতে অবশ্যই সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।