এনআইডি না থাকায় প্রবাসীদের নানা ভোগান্তি

14

পাসপোর্ট ও জন্মসনদে কারও নামের বানান ভুল, কারও বা বাবা-মায়ের। কারও জন্মতারিখ এবং কারও বা ঠিকানা। এ রকম কিছু ভুল বা অসংগতিসহ নানা কারণে এনআইডি পেতে ভোগান্তিতে রয়েছেন প্রবাসীরা। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না থাকায় বিশেষ করে ব্যাংকের লেনদেন ও জমিসংক্রান্ত অহরহ ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে তাদের। এ সমস্যায় অনেক প্রবাসী পাসপোর্টও করতে পারছেন না। এতে প্রবাস জীবনে তাদের নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, অনেক প্রবাসী এনআইডির জন্য আবেদন করলেও অনেক ক্ষেত্রে তদন্তে গিয়ে তাদের দেওয়া তথ্যের সত্যতা মিলছে না। ফলে এসব আবেদন বাতিল করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দেশে এসেই আবেদন করতে হবে।
জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক অবস্থান করছেন। প্রবাসে বসবাসরত এসব বাংলাদেশির অধিকাংশেরই এনআইডি নেই। এ কারণে তারা দেশ-বিদেশে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
প্রবাসীরা বলছেন, অনেকে দ্রæত প্রবাসে আসার জন্য বয়স পরিবর্তন করে পাসপোর্ট করেছিলেন। সে সময় জন্মসনদেরও বাধ্যবাধকতা ছিল না। পরে জন্ম বা শিক্ষাসনদের সঙ্গে পাসপোর্টের জন্মতারিখ ও তথ্যের অমিল থাকার বিষয়টি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এনআইডি না থাকায় প্রবাস জীবনে বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট-সংক্রান্ত নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আবার দেশে ফিরলে ব্যাংকের লেনদেন ও জমি-সংক্রান্ত নানা ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। এনআইডি জটিলতায় ব্যাংকে হিসাব খুলতে না পারায় টাকা নিজের নামে জমাতে পারছেন না কেউ কেউ। জমি কিনতে বা মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধন করতে বা ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্সÑসব ক্ষেত্রেই তাদের এনআইডি লাগছে। ই-পাসপোর্ট করতে গেলেও লাগছে এনআইডি। দেশে এবং প্রবাসে বাংলাদেশিদের এমন নানা সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রবাসে এনআইডি কার্যক্রম চালু করা হলেও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি অনেকে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রবাসীদের অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে এনআইডি পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করে ইসি। এতে ভালো সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তথ্যে গরমিলের কারণে অনেকের আবেদনই অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে। নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে অনেকের আবেদন। ফলে প্রবাসে এনআইডির কার্যক্রম চালু হলেও প্রবাসীদের ভোগান্তির যেন অবসান হচ্ছে না।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রবাসীদের এনআইডির আবেদন করতে অনলাইন জন্মসনদ, বৈধ বাংলাদেশি পাসপোর্টের কপি, এসএসসি/সমমানের শিক্ষাসনদ, আবেদনকারীর পিতা/মাতা/ভাই/বোন অথবা একজন রক্তের সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের (বাংলাদেশে বসবাসকারী) এনআইডি নম্বরসহ নানা কাগজপত্র বা ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। এ ছাড়া পাসপোর্ট ও জন্মসনদের তথ্যের মধ্যে মিল থাকারও শর্ত রয়েছে। কিন্তু এসব ডকুমেন্টের একটির সঙ্গে অন্যটির তথ্যের মিল না থাকায় অনেক প্রবাসী আবেদন করতে পারছেন না। আবার আবেদন জমা হলেও ভুলত্রæটির কারণে এনআইডি পাচ্ছেন না।
ইসি সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি পর্যন্ত প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশেই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সরবরাহ কার্যক্রমে ১৭ হাজার ১৭৫টি আবেদন পড়ে। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই ও তদন্ত শেষে মাত্র ৪ হাজারের মতো আবেদন অনুমোদন দেওয়া হয়, যা মোট আবেদনের মাত্র ২৩ শতাংশ। আবেদন বাতিল হয়েছে ২ হাজার ৪৯৪টি, যা মোট আবেদনের ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। এ ছাড়া তদন্তাধীন রয়েছে ৩৫৫টি আবেদন। অন্যদিকে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরুই হয়নিÑএমন নতুন আবেদন রয়েছে ১০ হাজার ৩৫৪টি, যা মোট আবেদনের ৬০ দশমিক ২৯ শতাংশ।
সূত্র আরও জানায়, জানুয়ারি পর্যন্ত সিঙ্গাপুর থেকে আবেদন হওয়া ৪৮০টির মধ্যে অনুমোদন পেয়েছে ২০টি; মালয়েশিয়া থেকে ৫৯০টির মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ৫৭টি; ব্রিটেন থেকে ১ হাজার ৮৫৫টির মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ৮০টি। এ ছাড়া ইতালি থেকে ১ হাজার ২৬১টির মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ৬৭টি; মালদ্বীপ থেকে ৫৪টির মধ্যে অনুমোদন হয়েছে তিনটি; সৌদি আরব থেকে ২ হাজার ১৬৬টির মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ১২১টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১০ হাজার ৭৬৯টির মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ৩ হাজার ৬২৪টি আবেদন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পর কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৯ সালে প্রবাসে এনআইডি সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসীদের মধ্যে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। তার আগে একই বছর ৫ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় অবস্থারত বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এবং স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার অংশ হিসেবে অনলাইনে আবেদন নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এরপর সৌদি আবর, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপে থাকা বাংলাদেশিদের জন্যও এ সুযোগ চালু করা হয়। সে সময় অনলাইনে আবেদন নিয়ে সেই আবেদন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপজেলা থেকে যাচাই করে সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্ট দেশে দূতাবাস থেকে এনআইডি সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে দূতাবাসের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা থমকে যায়।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই কার্যক্রমে ফের গতি আনে। এ ক্ষেত্রে আগের আবেদনগুলো পাশ কাটিয়ে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করেন তারা। ভবিষ্যতে ৪০টি দেশে এনআইডি সেবা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে আর প্রবাসে এনআইডি দেওয়ার প্রক্রিয়া একই। প্রবাসীদের জন্য আলাদা কোনো নিয়ম নেই। প্রবাসে বাংলাদেশি নাগরিকরা আবেদন করার সময় যেসব তথ্য দেবেন, সেগুলো দেশে তদন্ত হবে। তদন্তে সবকিছু ঠিক থাকলে তিনি এনআইডি পাবেন। তবে মিথ্যা কাগজ জমা দিলেই এনআইডি পাওয়া যাবে না বা রোহিঙ্গা যারা নানাভাবে প্রবাসে গেছেন, তাদেরও ভোটার হওয়ার সুযোগ নেই।
ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ কালবেলাকে বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী, অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বা বৈধ পাসপোর্ট যাদের নেই, তাদের আবেদন আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রবাসীদের অনেকেই আবেদন করলেও তদন্তে গিয়ে তাদের তথ্যের সত্যতা মিলছে না। ফলে তাদের আবেদন বাতিল করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দেশে এসেই আবেদন করতে হবে।