কাজির বাজার ডেস্ক
রমজানের বাকি এখনও প্রায় দুই মাস। অথচ রোজার বাজারে বেশি চাহিদা থাকা সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে বেশ কিছুটা। দাম বাড়ার পেছনে ডলার-সংকটকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নিত্যপণ্য আমদানিতে ডলারের সংকট নেই।
ভোটে জিতে নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে বাজারে লাগাম টানার একটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে সব দিক থেকে। যেমন রোববার বিকেলে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে চারজন মন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে ভোগ্যপণ্যের মজুত ও আমদানি পরিস্থিতি, চলমান ডলার-সংকট ও ঋণপত্র সহজীকরণ নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে নিত্যপণ্যের কোনো সংকট নেই। মধ্যস্বত্বভোগী কেউ কারসাজি করে দাম বাড়ালে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘রমজান মাসে যেসব পণ্য বিক্রি হয়, তা জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত গত বছরের চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি এলসি হয়েছে। এসব পণ্যের এলসি করতে ডলারের কোনো সংকট নেই।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২২ লাখ টন, শুধু রমজান মাসে ৩ লাখ টন। চিনির চাহিদা ২০ লাখ টন, রমজানে ৩ লাখ টন। খেজুরের চাহিদা ১ লাখ টন, রমজানে ৫০ হাজার টন। আর ছোলার চাহিদা ১ লাখ ২০ হাজার টন, রমজানে ১ লাখ টন।
মন্ত্রী-গভর্নররা এসব কথা বললেও বাজারের চিত্র ভিন্ন। পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী মেসার্স এস আলম এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী আলী আজগর বলেন, দেড় মাস আগে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৭৫-৭৬ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে ৮৪-৯২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৬২-৬৫ টাকার অ্যাংকর ডাল ৭০ টাকা, ৬৫ টাকার খেসারি ডাল ৯৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি থেকে পণ্য আসে পাড়া-মহল্লার দোকানে। ব্যবসায়ী শিপন আহমেদের দোকানে প্রতি কেজি ছোলা মানভেদে ১০০-১২০ টাকা, অ্যাংকর ৮০ টাকা, চিনি ১৫০ টাকা, মুগ ডাল ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে প্রতি ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতলের দাম ছিল ৮২৫ টাকা, বর্তমানে কোম্পানি ৮৪৬ টাকা করেছে। চিনিও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
দোকানি শিপন আহমেদ বলেন, ‘রোজার বাকি এখনো দুই মাস। অথচ ছোলা ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমার মনে হয়, রোজার সময় কেজি ১৫০ টাকা হবে।’
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে তেল-চিনির দামও বাড়তি। এক মাস আগে প্রতিমণ (৩৭ কেজি ৩২০ গ্রাম) চিনির দাম ছিল ৪ হাজার ৯০০ টাকা, রোববার তা ৪ হাজার ৯৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪ হাজার ৮২০ টাকার পাম তেল ৪ হাজার ৮৫০ টাকা, ৫ হাজার ৯৩০ টাকার সয়াবিন তেল এখন ৫ হাজার ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি আবুল হাসেম বলেন, মিল থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ দিলে রোজায় দাম আর বাড়বে না।
খেজুর আমদানিকারক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলার-সংকটে খেজুর আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না। অপর দিকে খেজুরের শুল্কায়ন বেড়েছে অস্বাভাবিক। গত বছর প্রতি কেজি খেজুরে শুল্কায়ন হতো ৫-১০ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে ১৭৬-২৭৬ টাকা হয়েছে। গত বছর যে খেজুর ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, বর্তমানে তা হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ১২০-১৫০ টাকার খেজুর বর্তমানে ৩৫০ টাকা।
পেঁয়াজ ছাড়া অন্য পণ্যের আমদানি কমেছে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল ৩ লাখ ৫৬ হাজার টন। আর সদ্য বিদায়ী বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এলসি খোলা হয় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৩০০ টন। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে আমদানি কম হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টন। ২০২২ সালের একই সময়ে অপরিশোধিত পাম তেল আমদানি হয় ৯ লাখ ৪১ হাজার ২৯ টন। আর ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছে ৮ লাখ ৭ হাজার ৭১৫ টন, যা আগের বছরের চেয়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার টন কম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে আরও জানা যায়, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল ১২ লাখ ৬৮ হাজার টন। এ বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৩৩ হাজার টন। অর্থাৎ ৫ লাখ টন কম এসেছে। ২০২২ সালে মসুর ডাল আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ১ হাজার টন। আর ২০২৩ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৮ টন বা ১ লাখ ৪১ হাজার টন কম। ছোলা আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার টন। আর গত বছর ১ লাখ ১১ হাজার ২৪৬ টন বা ১ লাখ ১৮ হাজার টন কম। আর খেজুর আমদানি হয়েছিল ৪৬ হাজার টন। গত বছর এলসি খোলা হয়েছে ৪৪ হাজার টন।
তবে বেড়েছে পেঁয়াজের আমদানি। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ১৯ হাজার টন। আর গত বছর একই সময় আমদানি হয় ৫ লাখ ৮৮ হাজার টন। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৯ হাজার টন।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে : আন্তর্জাতিক বাজারে গত দেড় মাসের ব্যবধানে চিনি, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও ছোলার দাম ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর মধ্যে চিনি প্রায় ৫ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ছোলার দাম ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমেছে।
এলসি খুলতে হিমশিম : ডলার-সংকটে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না বলে জানা গেছে। ব্যাংকে ধরনা দিলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ীকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি, খেজুরসহ আটটি খাদ্যপণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়, এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে। এই সুবিধায় আমদানির সুযোগ থাকবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু ব্যাংকে ডলার-সংকটে এ সুযোগ কাজে আসছে না।
খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এ জামান অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক নুরুল আলম জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক বাকিতে পণ্য আমদানির সুযোগ দিলেও ডলারের সংকটে ব্যাংক ঋণপত্র খুলছে না। এতে রমজানে নিত্যপণ্যের দামের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হবে। এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক বলেন, ডলার-সংকটের কারণে সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসায়ীকে এলসি দেওয়া যাচ্ছে না।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘রমজানের পণ্য আমদানির উপযুক্ত সময় এখন। তবে ডলার-সংকটে আমদানি কম।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘পণ্য আমদানি ২০ বা ২৫ শতাংশ কম হলে বাজারে সরবরাহের সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য আমদানি বাড়ানোর পদক্ষেপ এবং কারসাজি রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’