বড় রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড় থাকার মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। বিষয়টিকে অগণতান্ত্রিক শক্তি বিকাশের ঝুঁকি হিসাবে দেখছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। রোববার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, দৃশ্যমান নির্দেশক অনুযায়ী অবাধ ও অংশগ্রহণ নির্বাচনের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নির্মূল, যা উদ্বেগজনক। কারণ এর ফলে অগণতান্ত্রিক শক্তি বিকাশের ঝুঁকি বাড়ে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব তো আছেই, নির্বাচন কমিশনেরও কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে। টিআইবি বলেছে, নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্ব›দ্বমুক্ত ভ‚মিকা নিশ্চিতে উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য কমিশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের আস্থা অর্জনে নির্বাচন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপের উদাহরণও দেখাতে পারেনি। বরং দায়সারাভাবে আলোচনার আহŸান জানিয়েই তারা দায়িত্ব শেষ করেছে। একতরফা নির্বাচন গণতন্ত্র, জনগণের আস্থা এবং ভোটাধিকার নয়, এটি শুধু ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারে। সহিংসতা গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য অর্জনের পথ হতে পারে না। দেশের মানুষকে জিম্মি করে যে ক্ষমতার রাজনীতি, তা থেকে দলগুলোর সরে আসা উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এটা সত্য, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থাহীনতা, এর জেরে রাজপথে দলগুলোর মুখোমুখি অবস্থান, অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা দেশের সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। টিআইবির তথ্যমতে, গত এক মাসে প্রায় দুশ গাড়িতে এবং কয়েকটি ট্রেনে যে আগুন দেওয়া হয়েছে, তার দায় নিয়েও পালটাপালটি রাজনীতি চলছে। এ ধরনের কাজ স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য শুভ নয়। এসব সহিংস ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের কঠোর জবাবদিহির প্রয়োজন তো রয়েছেই, অপরাধের বিচারকে ভিন্নমত ও প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসাবে যেন ব্যবহার করা না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র ও নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক। জনগণই গণতন্ত্রের প্রাণ এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। আর জনগণ এই ক্ষমতা কেবল নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমেই প্রয়োগ করে। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া তাই গণতন্ত্রকে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের একমাত্র উপায় নির্বাচন।
এটা স্বীকার্য যে, এরশাদের শাসনামলের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ১০ বছর গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করেছিল। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ক্রমেই বিলুপ্ত হতে থাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ালী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর দুই রাজনৈতিক দলের শত্রæতা যে পর্যায়ে পৌঁছে, তারই ধারাবাহিকতা এখনো আমরা লক্ষ করছি। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এমনটা চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ তাই এখনই নেওয়া জরুরি। ক্ষমতাসীন দলের যেমন নমনীয় হওয়ার সুযোগ এখনো রয়েছে, তেমনই বিএনপিরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথ খুঁজে নেওয়ার সময় এখনো আছে। সর্বোপরি রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মী, নির্বাচন কমিশন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনসহ সব অংশীজনকে বাস্তবতা উপলব্ধি করে শান্তি ও সমঝোতার পথ অবলম্বনে উদ্যোগী হতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল অস্থিতিশীল ও সহিংস পথ পরিহার করবে, এটাই প্রত্যাশা।