নির্বাচনে ভরাডুবির পর হতাশায় ডুবছে বিএনপি ॥ মির্জা ফখরুলসহ সিনিয়র ৭ নেতাকে লন্ডনে ডেকেছেন তারেক রহমান

73

কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দিশেহারা বিএনপি। তারা এখন কি করবে, কোন পথে যাবে, কিভাবে যাবে কোন কিছুই ঠিক করতে পারছে না। নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের জন্য নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ করলেও কিভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এ নিয়ে কারো কোন ভাবনা নেই। তাই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তবে নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের কারণ জানতে এবং কোন্দল নিরসন করে দলকে এগিয়ে নেয়ার করণীয় ঠিক করতে বিএনপির ক’জন সিনিয়র নেতাকে লন্ডনে ডেকেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শীঘ্রই দলের ৭ নেতা লন্ডন যাচ্ছেন। সূত্র জানায়, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে ভরাডুবির পর চরম হতাশ হয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এ পর্যন্ত বেশ ক’টি বৈঠক করেও তারা ভবিষ্যত করণীয় ঠিক করতে পারছে না। বরং পরস্পরকে দোষারোপ করে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ক্লিনম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। তবে দলীয় কোন্দল ডেকে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি বিএনপির আলোচনা সভায় নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য মহাসচিব দায়ী এমন ইঙ্গিত করে প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়েন দলের দুই সিনিয়র নেতা। সর্বশেষ বুধবার বগুড়ায় স্থানীয় বিএনপি নেতারা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বাগবিত-ায় জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বড় নির্বাচনী জোট গঠন করে বিজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়েছিল বিএনপি। আর এ জন্যই দলের নেতারা বলতে শুরু করে ৩০ ডিসেম্বরই আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় হবে এবং খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশ পরিচালনার নেতৃত্ব দেবেন। নির্বাচনের পর দেশে আওয়ামী লীগ খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেও বিএনপি নেতারা দম্বোক্তি করে। এ ছাড়া কোন কারণে নির্বাচনে পরাজিত হলে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী দিয়ে দেশ অচল করে দেয়া হবে বলেও তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। কিন্তু মনোনয়নবাণিজ্য, নির্বাচনী প্রচারের কৌশল নিতে ভুল করা, জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে দেশ-বিদেশে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়া ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় করতে না পারায় তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়।
নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলের ভেতর কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকেও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করলে বিএনপিকে আর কোন ধরনের সহযোগিতা করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায় ড. কামাল হোসেন প্রকাশ্যেই বলেন, জামায়াতকে নির্বাচনে ধানের শীষ দেয়ার বিষয়টি তিনি প্রথমে জানতেন না, আর যখন জানতে পারেন তখন তড়িঘড়ি করে আর কিছু করার ছিল না। তবে নির্বাচনী জোটে জামায়াত থাকায় ভুল স্বীকার করে এ জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।
নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফন্ট গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ কিছু সিনিয়র নেতা। এ ছাড়া দলীয় মনোনয়নের বিষয়টিও তারাই দেখেন। এ জন্য তাদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন বিএনপির অন্য সিনিয়র নেতারা। এ জন্যই নির্বাচনে পরাজয়ের পর তারা মহাসচিবের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। সম্প্রতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ প্রকাশ্যেই তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করে দলের কোন্দলের বিষয়টি স্পষ্ট করেন।
এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের জামায়াত নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পর বিএনপির একাংশের নেতারাও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এ জন্য দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়ী করেন। আর দলের অপর অংশের নেতারা ড. কামালের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের জোট সঙ্গী জামায়াতও ড. কামালের প্রতিক্রিয়ার জবাবে কিছু না বলায় বিএনপির প্রতি নাখোশ হন। এ রকম পরিস্থিতিতে সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক বর্জন করেন বিএনপি নেতারা।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তার অনুসারীদের প্রতি ক্ষুব্ধ স্থায়ী কমিটির দুই সিনিয়র সদস্য জাতীয় কাউন্সিল ডেকে দলের নতুন কমিটি গঠন ও নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেন। তারা নেতৃত্ব পরিবর্তন বলে মূলত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে এ পদে বসানোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন বলেই বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন। এ পক্ষের কেউ কেউ আপাতত জাতীয় কাউন্সিল ডাকা সম্ভব না হলেও দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকার দাবি জানান। কিন্তু মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অনেক নেতাকর্মী জেলে ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং অনেকের নামে মামলা রয়েছে উল্লেখ করে এ পরিস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল কিংবা নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। আর এতে অন্য পক্ষের নেতারা আরও বেশি ক্ষুব্ধ হন।
ক্ষুব্ধ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমেই দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। তুলনামূলকভাবে ত্যাগী, যারা পরীক্ষিত নেতাকর্মী, তাদের নেতৃত্বে আনতে হবে। আমরা যারা ব্যর্থ বলে পরিচিত হয়েছি, আমাদের পদ ছেড়ে দিতে হবে। তাহলেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেন, যারা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তাদের নিজ নিজ এলাকার নেতাকর্মীদের মামলা থেকে পরিত্রাণ করা ও জেল থেকে মুক্ত করাতে হবে। যেসব এলাকায় আমাদের প্রার্থী ছিল না সেখানে দলের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করতে হবে।
অপর ক্ষুব্ধ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, যারা এই দুঃসময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের সামনের দিকে এনে দল পুনর্গঠন করতে হবে। দরকার হলে আমরা যারা, আমাদের বয়স হয়ে গেছে, আমরা সরে যাব। তারপরেও এই দলটাকে তো রাখতে হবে। এর একমাত্র উপায় হলো দল পুনর্গঠন করা।
মহাসচিব বিরোধী বিএনপির দুই সিনিয়র নেতার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মির্জা ফখরুলপন্থী নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে গাছাড়া ভাব দেখিয়ে এখন পরাজিত হয়ে তারা সব দোষ মহাসচিবের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। মির্জা ফখরুলতো কোন কাজ তাদের না জানিয়ে করেননি। সবকিছু দলীয় ফোরামে এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশেই করেছেন। এখন তারা মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে নিজেরা এ পদে আসতে উদ্দেশ্যমূল কথাবার্তা বলছেন। আর এর মাধ্যমে তারা দলে অনৈক্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিএনপির ভেতর যখন কোন্দল চাঙ্গা হওয়াসহ নানামুখী সমস্যা দেখা দেয় তখন জাতীয়তাবাদী কিছু বুদ্ধিজীবী লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা দলের কিছু সিনিয়র নেতাকে লন্ডনে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার কথা জানান তারেক রহমানকে। এরপর তারেক রহমান মহাসচিবসহ ৭ সিনিয়র নেতাকে লন্ডনে ডাকেন। শীঘ্রই তারা লন্ডন গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।
যে ৭ নেতাকে তারেক রহমান লন্ডনে ডেকেছেন বলে জানা গেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল মিন্টু ও আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠককালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ৬ জনের সংসদে যাওয়া-না যাওয়া ও উপজেলা নির্বাচনে দল অংশ নেবে কি না সে ব্যাপারে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপি এখন কি করবে এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, হতাশা থেকে কিভাবে মুক্ত হওয়া যায়, কিভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায় সে ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে আন্দোলন-সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতন স্বাভাবিক ঘটনা। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সেভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের ভাল ফল করা অসম্বব বিষয়। তবুও গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপিকে এখন সময়োপযোগী কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে কি কর্মসূচী হবে তা এখনও আমরা ঠিক করতে পারিনি। যখন হয় তখন সবাই জানতে পারবে।