কাজির বাজার ডেস্ক
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। বিশ্ববাজারে চাহিদার সিংহভাগ চালের জোগানদাতা দেশের এমন সিদ্ধান্তে চিন্তিত পুরো বিশ্ব। মজুত ভালো থাকলেও সংকট সৃষ্টি করে দেশের কোনো কোনো জায়গায় এরই মধ্যে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে দাম। অন্যদিকে সুগন্ধি চাল রপ্তানির জন্য মরিয়া দেশের কয়েকটি কোম্পানি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় চাওয়া হচ্ছে সম্মতি।
শুধু বাসমতী নয়, সব ধরনের চালের রপ্তানির ওপর দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ভারতের এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে তেজি হতে পারে চালের দাম। যদিও দেশে উৎপাদন ভালো, মজুতও আছে পর্যাপ্ত। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে বাজারকে অস্থির করার শঙ্কা করছেন কেউ কেউ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও আমদানির অজুহাতে বাড়িয়ে দেয়া হয় দাম। তবে খাদ্যমন্ত্রী মনে করেন, চালসংকটের আশঙ্কা নেই।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, চালের সংকট হওয়ার এখন কোনো কারণ নেই। ফলন ভালো হয়েছে। মোকামে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে। যদি কেউ কারসাজি করে মজুত আইনে নেয়া হবে ব্যবস্থা।
রাজধানীর বাজারে মোটা চালের কেজি এখন ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। আর মাঝারি মানের চাল ৬০ থেকে ৭০ এবং ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে সরু চাল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবির হিসাব বলছে, মাসের ব্যবধানে স্বর্ণা চালের দাম বেড়েছে আড়াই ভাগ।
চাল ব্যবসায়ী জানান, গত সপ্তাহের ৫০ থেকে ৫১ টাকা কেজি দরের গুটি স্বর্ণা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। অর্থাৎ বাজারে মোটা চাল (গুটি স্বর্ণা) কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছে।
দেশে উৎপাদন ও সরবরাহের বড় কোনো সংকট না থাকলেও খুচরা বাজারে বেড়েছে মোটা চালের দাম। পাইকারিতে দাম বাড়ায় বেড়েছে খুচরাও। রাজধানীতে কয়েক দিনে বস্তাপ্রতি মোটা চালের দাম পাইকারিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
চাল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জানান, ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলেই স্থানীয় বাজারে দাম বেড়ে যায়। তিনি বলেন, প্রতিটি মোকামে পর্যাপ্ত চাল আছে। চালের ঘাটতি নেই। কিন্তু কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা আছে। ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, চালের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখন দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। কিন্তু ভারতের রপ্তানি বন্ধের খবরে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এর আগে রপ্তানি বন্ধের পর স্থানীয় বাজারে দাম বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি দরকার।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গত কয়েক দিনে ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে ৫০ কেজির প্রতি বস্তার দাম ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত সপ্তাহে প্রতি বস্তা মোটা সেদ্ধ চালের দাম ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। চলতি সপ্তাহে তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫০ টাকা। সেদ্ধ মিনিকেটের দাম আগে ছিল ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ সপ্তাহে তা ৩ হাজার ২০০ টাকা। গুটি স্বর্ণার দাম ছিল ৩ হাজার ১০০ টাকা; এখন ৩ হাজার ৩০০ টাকা। দাম নিয়ন্ত্রণেই চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। গত ২০ জুলাই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায় ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড বা ডিজিএফটি। বাসমতী নয়, এমন সব সাদা চালের রপ্তানির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
ভারতের বাজারে চালের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। গত এক বছরে বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশ। এক মাসে বেড়েছে ৩ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে পণ্যটির ওপরে ২০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক চাপানো হলেও লাভ হয়নি। রপ্তানি উল্টে বেড়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় দেশের বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে পণ্যটির রপ্তানিনীতি বদল করে ভারত।
চালের বাজারে ভারতের কর্তৃত্ব : বিশ্বের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ চালের জোগান দেয় ভারত। প্রায় ১০০টি দেশে যায় ভারতের চাল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন, বেনিন, সেনেগাল, টোগো ইত্যাদি দেশগুলো। গত অর্থবছরে ভারত রপ্তানি করে ২ কোটি ১৫ লাখ টন চাল। উৎপাদনের দিক থেকে ভারত দ্বিতীয়। দেশটি বছরে গড়ে উৎপাদন করে থাকে ১৩ কোটি টন চাল।
চাহিদার সিংহভাগ চালই দেশে উৎপাদন হয়। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মাঝেমধ্যে কিছুটা বিঘœ হয় ফলন। তখন আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয় ঘাটতি। আমদানির ক্ষেত্রে প্রধান গন্তব্য হয় ভারত। প্রতিবছর দেশে চালের চাহিদা রয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ মেট্রিক টন। তবে দেশে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৫৫ লাখের টনের মতো। চাহিদার বিপরীতে চাল উৎপাদন না হওয়ায় বাকি ১৫ লাখ টন আমদানি করতে হয়।
লাগোয়া দেশ হওয়ায় চালের বড় অংশ আমদানি হয় ভারত থেকে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চালের বাজার বেসামাল হওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রপ্তানি। এতে বেড়েছে দুশ্চিন্তা। আমদানি বন্ধের অজুহাত দেখিয়ে অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিচ্ছে দাম।
সুগন্ধি চাল রপ্তানির পাঁয়তারা
তিনটি কোম্পানি সুগন্ধি চাল রপ্তানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। সুগন্ধি চাল রপ্তানির আবেদন করেছে ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেড। ২০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে কোম্পানিটি বলছে, ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস বিভিন্ন পণ্য মধ্যপ্রাচ্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, বাইরাইন, কাতার, ভারত, ভুটান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। এর আগে কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি ৪০০ টন সুগন্ধি চাল ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রপ্তানির অনুমতি দেয়। কিন্তু ওই সময় করোনা মহামারির কারণে তারা মাত্র ৫০০ কেজি চাল রপ্তানি করতে পারে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে সুগন্ধি চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনুমোদনপ্রাপ্ত অবশিষ্ট ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ কেজি সুগন্ধি চাল ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রপ্তানির অনুমতির সময় বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে কোম্পানিটি।
ইস্পাহানি এগ্রো লিমিডেট ১৮ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে জানায়, কোম্পানিটি এক হাজার মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি করতে ইচ্ছুক। ইতোমধ্যে তারা ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড ও সৌদি আরব থেকে রপ্তানির অর্ডার পেয়েছে। এতে রপ্তানি আয় আরও বাড়বে বলে মনে করছে কোম্পানিটি।
২০ জুলাই চাল রপ্তানির সময় বাড়ানোর আবেদন জানায় চট্টগ্রামের কোম্পানি হিফস এগ্রো ফুডস লিমিটেড। তারা বলছে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এক হাজার টন চাল রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দার কারণে তারা পর্যাপ্ত রপ্তানি করেত পারেনি। কিন্তু এখন তাদের কাছে প্রচুর অর্ডার আসছে। ইতোমধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি শেষ করেছে তারা। ফলে এক হাজার টন চাল রপ্তানির জন্য এক বছর সময় বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে কোম্পানিটি।
কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য
ফলন মৌসুমে চাল কিনে মজুত করছে বড় বড় করপোরেট কোম্পানি। প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের চাল। নেয়া হচ্ছে ইচ্ছামতো দাম। এসব কোম্পানির মজুতের কারণে চালের সংকট তৈরি হচ্ছে।
জানা যায়, পাঁচ থেকে ছয়টি কোম্পানি তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। আধুনিক বিপণন পদ্ধতিতে এসব প্রতিষ্ঠান আকর্ষণীয় মোড়কে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা করপোরেটদের ব্র্যান্ড ভ্যালুকে কাজে লাগিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছে। এর ফলে লাভবান হচ্ছে করপোরেট কোম্পানি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। বিপাকে পড়ছেন সাধারণ ভোক্তা।
ধান থেকে চাল রূপান্তর ও বিপণন খাতে দেশের বড় শিল্প গ্রæপ বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে চালের বাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে। এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে দেশের কয়েকটি বড় শিল্প গ্রæপ। তারা উত্তরবঙ্গভিত্তিক চালের চাতাল ও মিল পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে চালের দামও নির্ধারণ করছে। আর এ কারণে ছোট মিলাররাও ব্র্যান্ডের চালের দামের অনুপাতে তাদের চালও বাড়তি দামে বাজারে ছাড়ছে।