আওয়ামী লীগ বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে দেশজুড়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক

17

কাজির বাজার ডেস্ক
২৭ জুলাই ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ সফল করতে দু’দলই তোড়জোড় প্রস্তুতি চলছে। একদিকে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো করছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ঢাকা ও আশপাশের জেলার নেতাকর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। পাশাপাশি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধাংদেহী প্রস্তুতি নিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আন্দোলনকারীদের যে কোনো ধরনের নাশকতা থেকে নগরবাসীর জানমাল নিরাপদ রাখতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারকরা। তবে তাতেও জনমনে স্বস্তি ফিরছে না। বরং ২৭ জুলাই কী হবে- এমন শঙ্কায় বাড়ছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। শুধু দেশের সাধারণ মানুষই নয়, বিএনপি-আওয়ামী লীগের এ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও চরম উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, এ দিন নগরীর বিপুল সংখ্যক স্পটে এ দুই দলের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি হতে পারেন। জড়িয়ে পড়তে পারেন সংঘাত-সংঘর্ষে। একাধিক স্থানে ঘটতে পারে অনাকাক্সিক্ষত নানা ঘটনা। যা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে তীব্র যানজটে গোটা নগরী স্থবির হয়ে পড়বে, যা নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশকে হিমশিম খেতে হবে বলেও আশঙ্কা করছেন এ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে ২৭ জুলাই দিনভর গোটা নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নামবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক শক্তির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে নগরীর যে কোনো এলাকা মুহ‚র্তে রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। এ শঙ্কায় অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রায় কেউই এ দিন ঘরের বাইরে বের হবেন না। চাকরিজীবী ও পেশাজীবীরা কর্মস্থলে গেলেও ভুলেও কোনো শপিং মল, মার্কেট কিংবা বিপণি বিতানে সাধারণ কেনাকাটার জন্য ঢু মারবেন না। ফলে বেচাকেনার মন্দার এ সিজনে ২৭ জুলাই তাদের ব্যবসায় আরও বড় ধাক্কা লাগবে। একই দিনে বিএনপির মহাসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ আদৌও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে কি না, নাকি দিনভর পাল্টাপাল্টি হামলায় গোটা নগরী অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে- এ আশঙ্কায় স্কুল-কলেজগামী সন্তানদের ২৭ জুলাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা। বিশেষ করে শিশু-সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তারা। তবে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা অনেকেই এদিন সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করে ফেলেছেন।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ২৭ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপি-আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে রক্তাক্ত সহিংসতা, নাশকতা, নৈরাজ্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়ংকর অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। তাই এই দুই সমাবেশ সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি।
প্রসঙ্গত, ২৭ জুলাই সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করতে পুলিশকে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। মহাসমাবেশস্থলের আশপাশের আরও ১০টি এলাকায় বিএনপির সমমনা দলগুলো পৃথক সমাবেশ করবে। এভাবে বিপুলসংখ্যক লোক জড়ো করে শহরের বড় অংশ নিজেদের দখলে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
একই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে রাজধানীতে শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন। সোমবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। বলা হয়, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে নেতাকর্মীরা বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ-পশ্চিম গেটে জড়ো হবেন, বেলা ১টা থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, বিকাল ৩টা থেকে শুরু হবে সমাবেশ।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ঢাকার মহাসমাবেশ আন্দোলনের বাঁক বদলে দেবে। এ জন্য এই কর্মসূচি ঘিরে সব পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। মহাসমাবেশ থেকে আন্দোলনকে চ‚ড়ান্ত পরিণতি দেওয়ার লক্ষ্যে আরও কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আর এ ভয়েই আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচি বানচাল করতে পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে।
একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ধারণা, মহাসমাবেশে লোক জমায়েতের ক্ষেত্রে সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পথে পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হতে পারে। সমাবেশের অনুমতি প্রশ্নেও তৈরি করা হতে পারে জটিলতা। তাই সব বিষয় বিবেচনায় রেখে বাধা উপেক্ষা করে কীভাবে সমাবেশে আসতে হবে, সেই পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে।
২৭ জুলাই বিএনপির মিত্র দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ জাতীয় প্রেস ক্লাব অথবা মৎস্য ভবনের সামনে, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি যৌথভাবে মতিঝিলে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি পান্থপথে দলীয় কার্যালয়ের সামনে, নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ পল্টনে, ১২ দলীয় জোট বিজয়নগর পানির ট্যাংকি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট পল্টনের আল-রাজী কমপ্লেক্সের সামনে, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য জাতীয় প্রেস ক্লাবে, বাংলাদেশ লেবার পার্টি পল্টনে, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে এবং আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি) পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করবে বলে জানা গেছে। বিএনপির সমাবেশের পাল্টা এই সমাবেশ করছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। রাজনৈতিক দল হিসেবে সহাবস্থানে থেকে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবেন। সাপ্তাহিক কর্মব্যস্ততার দিনে দুই দলের পাল্টাপাল্টি এমন সমাবেশ যানজট ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টির যে শঙ্কা রয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নিখিল বলেন, এ বিষয়টিও তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখেছেন।
এদিকে, মহাসমাবেশের প্রস্তুতি সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, ঢাকায় মহাসমাবেশের দিন পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে সরকার দেশে সংঘাত সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তিনি বলেন, সরকারের বিশেষ ব্যক্তিরা উসকানিমূলক কথা বলছেন এবং উসকানিমূলক কাজ করছেন। যুবলীগ তাদের ২৪ জুলাইয়ের (সোমবার) কর্মসূচি ২৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) নিয়েছে। এটা পরিষ্কার, একটা সংঘাতমূলক অবস্থা সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই তারা এটা করছে। এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদি কোনো রকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে, তার দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যত আন্দোলন করে এসেছি, আমাদের প্রতিটি আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। আমাদের ওপর অনেক আক্রমণ হয়েছে, অনেক লোককে আহত করা হয়েছে। এর পরও আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি।’
এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এস কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা মাঠে নেমেছি। নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকব। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করে তারপর আমরা ঘরে উঠব। বিএনপি চাইলেও কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে না। দেশের মানুষ তাদের প্রতিরোধ করবে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ সংঘাত চায় না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংঘাতের কোনো আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, ‘সংঘাতের উসকানি আমরা কখনো দেব না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দেশ চালাতে চাই। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। শুধু শুধু দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে লাভ নেই, বরং ক্ষতি। আমরা অশান্তি চাই না। কেউ অশান্তি করলে জনগণের জানমাল রক্ষা ও শান্তির জন্য আমরা প্রটেকশন দেব। জনগণের স্বার্থ রক্ষায় আমরা প্রটেকশনে দেব।’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বেশ কয়েক মাস ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি, পাল্টা কর্মসূচি অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে চললেও ১৮ জুলাই দুই দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষসহ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে গত বছর অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা দেখা গেছে। কিন্তু এ বছর মধ্য জুলাই পর্যন্ত দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকলেও বড় ধরনের সংঘর্ষের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে বিএনপি গত ১২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করায় রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রæত পরিবর্তন আসে এবং প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। শুধু সরকার পতন নয়, এ সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। ওই দিনই আওয়ামী লীগও ঘোষণা দেয় নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার সরকারই ক্ষমতায় থাকবে এবং নির্বাচন ঠেকাতে এলে তা প্রতিহত করা হবে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে দুই দলই লক্ষ্যে পৌঁছানো এবং অবস্থান ধরে রাখার চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে সংঘাত-সহিংসতার উদ্বেগ বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিরোধী দল যেদিন কর্মসূচি ডাক দিল, ওই একই দিনে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দেওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের আচরণ খুবই উত্তেজক বলে মনে হচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং একটি খারাপ রাজনৈতিক অনুশীলন।’ তিনি বলেন, ‘চলমান সংকটের কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান আমি দেখছি না। কারণ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই কোনো সমঝোতার মনোভাব দেখাচ্ছে না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে, দেশকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই সময়ে রাজনীতির মাঠ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না এবং এই এক দফা দাবিতে তারা মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। যত আন্দোলন করার তারা করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অসম্ভব হতে পারে।’