সিন্টু রঞ্জন চন্দ
ঈদুল আযহায় গরু কোরবানি দেওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা পশুর (গরু-মহিষ-ছাগল) সংগ্রহকৃত উচ্ছিষ্ট মাথার খুলি, হাড় ও শিং দেশে-বিদেশে সিলেট থেকে রপ্তানি হওয়ার নতুন সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও ব্যাংকের ঋণ সুবিধা না থাকায় এ ব্যবসা থেকে ফিরে আসার উপক্রম হয়েছে সিলেটের কয়েকজন ব্যবসায়ীর।
ব্যবসায়ীদের দাবী- যদি সরকার ব্যাংকের ঋণ সুবিধা না দেয় তাহলে পরিবেশ দূষণমুক্ত এ ব্যবসা আমাদের বন্ধ করতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই অতিসত্তর সরকার আমাদের ঋণ সুবিধা দেওয়ার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি।
সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের পারাইচক এলাকায় ব্যাংকের ঋণ না পাওয়ার কারণে অপরিকল্পিতভাবে কয়েক জন ব্যবসায়ী প্রায় ৯ থেকে ১১ বছর ধরে কোন রকমে এ ব্যবসা চালিয়ে আসছেন বলে জানালেন মেসার্স ফয়েজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত¡াধিকারী মোঃ লায়েক আহমদ।
ব্যবসায়ী মোঃ লায়েক আহমদ বলেন, কোরবানির পশুর বর্জ্য মানুষ ফেলে দেয়। কিছু কুকুরেও খেয়ে ফেলে। আবার কিছু বর্জ্য পঁচে-গলে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। অথচ দুইমণ ওজনের প্রতিটি গরু থেকে প্রাকৃতিক সার তৈরির জন্য ২০ কেজি বর্জ্য তৈরি হয়। পেনিস ও গোল্লা (ভুঁড়ি) রফতানি হয়। প্রতিটি পেনিসের রফতানিমূল্য ৪ থেকে ৬ ডলার ও গোল্লার মূল্য ১০-১২ ডলার। তিনি বলেন, স্থানীয় ওষুধ শিল্পের জন্য হাড়ের চাহিদা রয়েছে। এগুলোকে হাজার কোটি টাকার সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি ওষুধ উৎপাদনকারি বেক্সিমকো, অপসোনিনসহ সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসলে পরিবেশ দূষণমুক্তের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ঈদ চলে যাওয়ার পরই ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কোরবানির পশুর ফেলে দেয়া হাড় কেনা, সেগুলো ঠিকমতো মেপে বুঝে নেয়া, পরিষ্কার করা, রোদে শুকানো ইত্যাদি কাজের জন্য স্থানীয় ব্যাংক ঋণ সুবিধা না থাকায় এ ব্যবসা চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এখন অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসব হাড় ব্যবসার কাজ করে যেতে হচ্ছে। আমি মনে করি এসব দিক বিবেচনা করে স্থানীয় ব্যাংক আমাদের ঋণ দিয়ে হাড় ব্যবসার মান উন্নয়নে এগিয়ে আসা উচিৎ। তিনি বলেন, অন্যান্য জেলার হাড় ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হয় অথচ আমাদের সিলেটে ব্যবসায়ীদের রহস্যজনক কারণে ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয় না।
তিনি আরো বলেন, দেশের পশুর হাড়ের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে কোরবানির ঈদ। ঈদের পর ফেলে দেয়া হাড়গুড় মূলত এ খাতের ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রেখেছে। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারের কসাইরা তাদের বছরজুড়ে হাড় সরবরাহ করে থাকেন। তাই প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে ব্যবসার মৌসুম হিসেবে টার্গেট হয় এসব হাড় ব্যবসার। তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন টুকাইর কাছ থেকে কেজি দরে ক্রয় করে পশুর হাড় সংগ্রহ করে থাকি। পরে প্রসেসিং করা হয়। এরপর টন করে ট্রাকে করে ঢাকা, বরিশাল ও যশোরে বেপারীদের কাছে বিক্রি করে থাকি। এতে লাভ হয় সামান্য। তারা পরে এসব পশুর বর্জ্য-হাড়, শিং, চামড়া, ভুঁড়ি, পেনিস, মূত্রথলি, চর্বি, রক্ত-ইত্যাদি সবই মিশিনে প্রসেসিং করে দেশের পাশাপাশি চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি করেন। তিনি বলেন, এখন আমাদের একটাই দাবী স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ পেলে এ ব্যবসা আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, পশুর হাড় দিয়ে ওষুধ ক্যাপসুলের কাভার, মুরগি ও মাছের খাবার, জৈব সার, চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরি হয়। নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, পায়ের খুর দিয়ে অডিও ভিডিওর ক্লিপ, অন্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয় জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুল। গরুর রক্ত শুকিয়ে বøাড মিল তৈরি করা যায়। সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহৃত হয়। এছাড়া জার্মানি ও ইতালিতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পশুর শিং সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তাই এই খাতে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে অপ্রচলিত এই পণ্যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, পরিত্যক্ত পশুর হাড় পরিবেশ দূষণ করে। আমাদের দেশে পশু জবেহের পর পশুর হাড় খাল বিল জলাশয় বা উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দেয়ার প্রবণতা আছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এই অবস্থায় এই সব পশুর বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। আব্দুল করিম কিম আরো বলেন, এ পেশার সাথে যারা জড়িত তাদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া উচিত। তাছাড়া তাদের সহজ কিস্তিতে ব্যাংকের ঋণ সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হউক।
এ ব্যবসাকে সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে দ্য সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, সিলেটে এই কুরবানি ঈদে গবাদি-পশু জবাই হয়েছে প্রায় চার লক্ষাধিক। এছাড়া সিলেট জেলায় দৈনিক প্রায় এক হাজার গবাদি-পশুও জবাই হয়। এই পশুর উচ্ছিষ্ট বর্জ্য যেমন হাড়, শিং, অÐকোষ, মূত্রথলি ও চর্বি দিয়ে যে বহুমাত্রিক ব্যবহার করা যায় তা সম্পর্কে সিলেটের মানুষ অজ্ঞ। তিনি বলেন, এবিষয়ে সেমিনার সেম্পজিয়াম করা প্রয়োজন। এ শিল্পের সাথে জড়িতদের নিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে সিলেট চেম্বার। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারের এবিষয়ে আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়কে এবিষয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারবে। তিনি বলেন, সিলেটে এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা ও ব্যবসাটি প্রসারের জন ‘এসএমই’ লোন সহায়তা দিয়ে তাদেরকে সাহায্যে করা যেতে পারে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করতে পারে বলে জানান সিলেট চেম্বারের সভাপতি তাহমিন আহমদ।
সিলেট বিভাগীয় প্রাণী সম্পদ অফিসের পরিচালক ড. মারুফ হাসানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পশুর উচ্ছিষ্ট হাড় ও শিং ব্যবসাটি একটি লাভজনক ব্যবসা। সিলেটে এ ব্যাতিক্রমী ব্যবসায় মানুষের অনেক উপকারে আসে। তবে এটা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের নয় এটা রপ্তানি বাণিজ্য বা পশুসম্পদ মন্ত্রাণলায়ের অধীনে। তিনি বলেন, অপ্রচলিত পণ্য বাংলাদেশ সরকার স্বীস্কৃত দিয়েছে। যদি ব্যবসায়ীর বৈধ কাগজপত্র থাকে তাহলে তাকে কৃষি অধিদপ্তরকে অনুরোধ করে ব্যাংকের ঋণসহ সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা করা হবে বলে জানান এই পরিচালক।