হত্যা মামলায় ৩ জনের ফাঁসি

14

সিন্টু রঞ্জন চন্দ

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে চাঞ্চল্যকর স্বামী আব্দুস সালাম ও মেয়ে রুলি বেগমকে (ডাবল মার্ডার) হত্যার দায়েরকৃত মামলায় স্ত্রীসহ ৩ জনের ফাঁসি (মৃত্যুদন্ড) ও দুই আসামীকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। রায়ের পাশাপাশি ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ৩ আসামীকে ২০ হাজার টাকাও জরিমানা করা হয়। রবিবার দুপুরে সিলেটের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ৫ এর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৪র্থ আদালতের বিচারক শায়লা শারমিন চাঞ্চল্যকর মামলার এ রায় ঘোষনা করেন। রবিবার বিকেলে ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোঃ কবির হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হচ্ছেন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার পুটিমারা পূর্বপাড়ার নিহত আব্দুস সালামের স্ত্রী রুশনা বেগম (৩৬), একই এলাকার মৃত এছির উরফে ইয়াছির আলীর ছেলে মোঃ মখন মিয়া (৪০) ও চাঁদ মিয়ার ছেলে মন্নাফ (৩৮)। রায় ঘোষনার সময় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী মন্নাফ (পলাতক) আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন না। খালাসপ্রাপ্তরা হচ্ছেন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার পুটিমারা পূর্বপাড়ার মৃত রশিদ আলীর ছেলে মোঃ গনু মিয়া (৩৮) ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার পুটিমারা পশ্চিমপাড়ার মৃত মখলিছ মিয়ার ছেলে মোঃ ফারুক (৩২)।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার পুটিমারা পূর্বপাড়ার আব্দুস সালামের (৫০) স্ত্রী রুশনা বেগমের সাথে একই এলাকার মৃত এছির উরফে ইয়াছির আলীর ছেলে মোঃ মখন মিয়ার দীর্ঘদিন পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক চলে আসছিলো। একদিন বিষয়টি রুশনা বেগমের মেয়ে রুলি বেগম (১৭) তার এই অবৈধ সম্পর্ক দেখতে পেয়ে তার পিতাকে জানায়। এনিয়ে আব্দুস সালাম ও রুশনার মধ্যে পারিবারিক কলহ চলে আসছিলো। পরে রুশনা বেগম বিষয়টি নিয়ে তার পরকীয়া প্রেমিক মোঃ মখন মিয়াকে জানায়। এ নিয়ে রুশনা বেগম ও মখন মিয়াসহ আসামীরা মিলে আব্দুস সালাম ও রুলি বেগমকে হত্যার জন্য পরিপল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ২০১৬ সালের ১৩ আগষ্ট রাত ৯ টার দিকে রুশনা বেগমসহ আসামীরা আব্দুস সালাম ও তার মেয়ে রুলি বেগমকে কৌশলে কোম্পানীগঞ্জের টাইয়া পাগলা গ্রামের পশ্চিমে পাথর চাউলী হাওড়ের (বড় হাওড়) রাস্তার পাশের একটি খালে নিয়ে যায়। সেখানে আসামীরা মিলে আব্দুস সালাম ও মেয়ে রুলি বেগমকে নৌকার বৈঠা ও চাকু দিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। ঘটনার ২দিন পর ১৫ আগষ্ট সকালে রুলি বেগমের লাশ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ গিয়ে রুলি বেগমের লাশ উদ্ধার করে এবং ঐদিন বিকেলে একই স্থানের পাশের আরেকটি ডুবা থেকে আব্দুস সালামের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে।
এদিকে ঘটনাটি দামাচাপা দিতে রুশনা বেগম বিষয়টির নাটক সাজিয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার পুটিমারা পূর্বপাড়ার মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে ভাসুর আব্দুর নুর, ভাসুর আব্দুর নুরের ছেলে লাল মিয়া, আব্দুর রবের ছেলে ফরিদ তার সহোদর সোহেল মিয়া, মানিক মিয়া, হোসেন আলীর ছেলে সেলিম মিয়া ও ফাহিমা বেগম তার মা এবং রুশনার ঝা নেহারুন ও নূরুল আমিনকে আসামী করে কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার নং ১১ (১৫-০৮-২০১৬)। পরে এ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) মুহাম্মদ রুহুল আমীন।
রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি অ্যাডভোকেট আব্দুস সত্তার ও এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট দীনা ইয়াসমীন বলেন, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) মুহাম্মদ রুহুল আমীন মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে রুশনা বেগমের আদালতে ফৌজধারী আইনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী ও তার এজাহারের দায়েরকৃত মামলার মিল পাননি। ফলে ঘটনার বিষয়টি তদন্তকারী পুলিশের এই কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তারা বলেন, পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা মুহাম্মদ রুহুল আমীন রুশনা বেগমের দায়েরকৃত মামলার সকল আসামীকে বাদ দিয়ে ২০১৭ সালের ২৯ মে আদালতে তিনি চুড়ান্ত (২৫ নং) প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে সরাসরি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেটকে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। পরে এ মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিলেট পিবিআইর পুলিশ পরিদর্শক দেওয়ান আবুল হোসেন। তার তদন্তভার গ্রহণ করার পর রুশনা বেগমের মোবাইল নম্বরের কললিস্ট সংগ্রহ করেন এবং সে একেক সময় একেক কথা বলায় বিষয়টি পুলিশের সন্দেহ হয়। তখন দতন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করে দেখা যায় ১৫ দিনে রুশনা বেগম ১ হাজার ৬৪ বারের কথা রেকর্ড হয়। এই কললিস্টের সূত্র ধরে পিবিআইর পুলিশ পরিদর্শক দেওয়ান আবুল হোসেন ঘটনা ও হত্যাকান্ডের মুল রহস্য উদঘাটন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি অ্যাডভোকেট আব্দুস সত্তার আরো বলেন, সিলেট আদালতে আসামী ইলিয়াছুর রহমানের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী প্রদান করেন। রুশনা বেগমের পরকীয়া প্রেমের কারনেই স্বামী আব্দুস সালাম ও মেয়ে রুলি বেগমকে হত্যার পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যার বিষয় রুশনা বেগম, মোঃ মখন মিয়া, মন্নাফ, মোঃ গনু মিয়া, মোঃ ফারুক মিয়া, ইলিয়াছুর রহমান জড়িত থাকায় রুশনা বেগমের বাদী হওয়া সাজানো মামলাটির চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং পিবিআই’র তদন্তকারী কর্মকর্তা দেওয়ান আবুল হোসেন নিজেই বাদী হয়ে উক্ত আসামীদের বিরুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার নং- ২ (০১-০৫-২০১৭)।
মামলা চলাকালীন সময়ে ইলিয়াছুর রহমান মারা যান। তিনি বলেন, এছাড়া ঘটনার ১৭ মাস পর জেলে থাকা রুশনা বেগমের গর্ভে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। বর্তমানে রুশনা বেগম ওই মেয়েকে নিয়ে জেলে হাজতবাস করছেন।
পিবিআইর পুলিশ পরিদর্শক দেওয়ান আবুল হোসেন দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর আসামী রুশনা বেগম, মোঃ মখন মিয়া, মন্নাফ, মোঃ গনু মিয়া, মোঃ ফারুক মিয়াকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র নং-১৪৫) দাখিল করেন।
দীর্ঘ শুনানী ও ৩০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে রবিবার আদালত আসামী রুশনা বেগম, মখন মিয়া ও মন্নাফকে দ্যা পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩০২/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্তক্রমে তাদেরকে মৃত্যুদন্ড (ফাঁসি) ও ২০ হাজার টাকা জরিমানার দন্ডের আদেশ প্রদান করেন এবং আসামী রুশনা বেগমকে পেনাল কোড এর ২০১ ধারায় ৫ বছরেরর সশ্রম কারাদন্ড ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ১ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন আদালত।
রায়ের আদেশে আরো বলা হয়েছে, আসামী রুশনা বেগমের সাথে হাজতে থাকা তার নাবালিকা কন্যা সাবিনা ইয়াজমিন পলি এর বিষয়ে শিশু আইন ২০১৩ এর দশম অধ্যায় বর্ণিত বিধান অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া আসামী গনু মিয়া ও মোঃ ফারুককে পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩০২, ২০১/৩৪ ধারার অভিযোগের দায় হতে খালাস প্রদান করেন আদালত।
মামলাটি পরিচালনা করেন রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি অ্যাডভোকেট আব্দুস সত্তার ও এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট দীনা ইয়াসমীন, আসামীপক্ষে অ্যাডভোকেট মাজেদ আহমদ ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মুহিবুর রহমান।