কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মহামারী করোনার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে সম্ভাব্য বিশ্ব মন্দার ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফকে পাশে চায় বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার। অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন এবং শিক্ষা কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক এ সংস্থা দুটির ঋণ সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সদর দফতরে চলমান বার্ষিক সম্মেলনে এ সংক্রান্ত একটি রূপরেখা তুলে ধরা হবে। ইতোমধ্যে বেশকিছু শর্তসাপেক্ষে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সংস্থা দুটি। বাজেট সহায়তার অর্থ যাতে দ্রুত ছাড়করণ করা হয় থাকে সে বিষয়েও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছ থেকে আগামী তিন বছরে বিশেষ কিছু শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশের ৫৫০ কোটি (৫.৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব ঋণের অর্থ এখন দ্রুত ছাড়ের বিষয়ে জোর দিচ্ছে সরকার। এছাড়া বাজেট সহায়তার চেয়েও সবচেয়ে বেশি জরুরী সম্ভাব্য বিশ্বমন্দার ঝুঁকি এড়ানো এবং দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বমন্দায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এ কারণে বিদেশী ঋণ পেতে আগেভাগে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের চলমান বার্ষিক সম্মেলনে এবার সম্ভাব্য বিশ্বমন্দা মোকাবেলায় সংস্থা দুটির ঋণ সহায়তা চাওয়া হবে। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) বার্ষিক সম্মেলন শেষে ফিলিপাইন থেকে সদ্য দেশে ফিরেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এ কারণে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠকে যোগদান না করলেও অর্থমন্ত্রী বার্ষিক সভার জন্য একটি গাইড লাইন তৈরি করেছেন। আলোচনায় অর্থমন্ত্রীর দেয়া গাইড লাইন অনুযায়ী ঋণ সহায়তা নিয়ে আলোচনা করবে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নেতৃত্বে এবারের সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, ইআরডি সচিব শরিফা খান, ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আবদুল বাকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান, অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোঃ ফেরদৌস আলম, অর্থ বিভাগের উপসচিব আবু দাইয়ান মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ এবং অর্থমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সৈয়দ আলী বিন হাসান। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ শফিউল আলম, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান ও ইকোনমিক মিনিস্টার মোঃ মেহেদী হাসান দলের সদস্য হিসেবে আছেন।
সফরে এবার বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার, আইএমএফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ্যান্থনি এম সায়ের ও এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দসহ সম্মেলনের ফাঁকে কয়েকটি বৈঠক করবে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল।
এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের সম্মেলনে চলতি অর্থবছরে বাজেটে সহায়তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে বাজেট সহায়তা হিসেবে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়া হবে। আলোচনা শেষে ঋণ পাওয়া গেলে আগামী তিন বছরে বাজেট সহায়তা হিসেবে এই টাকা আসবে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে প্রায় সব ধরনের আলোচনা হয়ে গেছে। তবে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হবে বার্ষিক সম্মেলনে। তিনি জানান, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থা থেকে বিশ্ব মন্দার আশঙ্কা করা হয়েছে। বৈশ্বিক এ সঙ্কট থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশ। এ কারণে বিশ্ব মন্দা মোকাবেলায় সংস্থা দুটির ঋণ সহায়তা ও পরামর্শ চাওয়া হবে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর এবং দাতা সংস্থাগুলো মিলিত হয়েছেন এবারের এ সম্মেলনে। এবারের বৈঠকে আলোচ্য ইস্যু হচ্ছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনা। চলতি অর্থবছরের বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে আইএমএফ খুবই ইতিবাচক। তাদের দু-একজনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কথা হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী। এই ঋণ বাংলাদেশ অবশ্যই পাবে। কারণ আমাদের ঋণ পরিশোধের রেকর্ড সবসময় ভাল।
এদিকে আগামী ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ৭ দিন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বার্ষিক সম্মেলনে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে ১৮০টি বৈঠক হবে। এসব বৈঠকে অংশ নিতে বিভিন্ন দেশ থেকে ২০১৮ জন প্রতিনিধি হাজির হয়েছেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। এবার সম্মেলনে কয়েকটি ইস্যুকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় থাকছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস। আলোচ্য ইস্যুর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্য সরবরাহ চেইনে বিরূপ প্রভাব ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়।
এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তার হুমকিতে বিশ্ব, খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, ইউরো সঙ্কট, খাদ্য সঙ্কটের নেপথ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও ইউক্রেন যুদ্ধ এসব বিষয়ও থাকছে। এছাড়া রেমিটেন্স ও হুন্ডি পাচার, খাদ্য নিরাপত্তা ও সরবরাহ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করবেন বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক খাতের নেতারা। এছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির ফোকাস, জলবায়ু মোকাবেলায় জরুরী ভিত্তিতে অর্থায়ন, গুণগত অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ, বিশ্বব্যাজারে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব, কোভিড-১৯ পরবর্তী কৃষি খাতের মজুরির ভিন্নতাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা হবে। উল্লেখ্য, বহুজাতিক এই দুই সংস্থা বছরে দুদফা বৈঠকে বসে। একটি বসন্তকালীন সভা, যা এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয়, আরেকটি হয় অক্টোবরে। কোভিডের কারণে গত দুই বছর ভার্চুয়ালি সভার পর এবার সরাসরি বৈঠক হতে যাচ্ছে।