কাজিরবাজার ডেস্ক :
শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই নৌবন্দরকে কেন্দ্র করে শিল্পায়ন ও নগরায়ন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নয়নে রেল, সড়ক ও আকাশ পথ যুক্ত হলেও এখনও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাশ্রয়ী ধরা হয় নৌপথকে। বিশ্ববাণিজ্যের সিংহভাগ পণ্য পরিবাহিত হয় নৌপথে। বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক পণ্যবাণিজ্যের উদীয়মান দেশ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছে। তবে অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনে এখনও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি নৌপথ।
তাই নৌপথে পণ্য পরিবহন জনপ্রিয় করতে সরকার আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কন্টেনার নদীবন্দর স্থাপনের প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে কন্টেনার আসা-যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে পণ্য পরিবহন আরও সহজ হবে। যা অঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক গতি ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্পটি সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি ভারতের সঙ্গে বেশি বেশি বাণিজ্য করতে। আশুগঞ্জ বন্দরটি হলে অসমের সঙ্গে বাণিজ্য হবে। আগরতলার সঙ্গে বাণিজ্য হবে।’
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক আশুগঞ্জ নৌবন্দরের ফলে কী ধরনের লাভ হবে তা নিয়ে কথা বলেন জনকণ্ঠের সঙ্গে। তিনি বলেন, আশুগঞ্জে কার্গো সুবিধা আছে, এখন কন্টেনার সুবিধা যুক্ত হলে পণ্য পরিবহনে রাস্তার ওপর থেকে চাপ কমে আসবে।
নৌপথ জনপ্রিয় করে তুলতে সরকারের লক্ষ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার সড়কের ওপর থেকে চাপ কমাতে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। নৌপথ কমতে কমতে আড়াই হাজার কিলোমিটারে চলে এসেছিল, তবে এখন তা ৬ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে।
৩৭টি নদীবন্দর নিয়ে কাজ করছে সরকার। ঢাকার চারপাশে ১৪টি জেটি নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলছে বলে জানান নৌপথ তদারককারী সংস্থার এ কর্ণধার।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে মোট নৌপথের দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি। যেখানে যাতায়াতযোগ্য নৌপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার। তবে শুষ্ক মৌসুমে তা আরও কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটারে। অথচ ১৯৬০ সালেও দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার। ছয় দশকে নদীপথের দৈর্ঘ্য কমে অর্ধেক হলেও ধীরে ধীরে আগের চেয়ে বাড়ছে পণ্য পরিবহন।
নৌপথ দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। তাদের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহন হয়েছিল প্রায় ১৪১ লাখ টন। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৫৯ লাখ টন পণ্য পরিবহন করা হয়েছে। ফলে এক দশকের কম সময়ে পণ্য পরিবহন বেড়েছে প্রায় চারগুণ।
বর্তমান সরকার নৌপথকে জনপ্রিয় করতে ড্রেজিংসহ ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ‘আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কন্টেনার নদীবন্দর স্থাপনের’ প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
গত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির ব্যয় ৪৫৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে এক হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। যেখানে ভারতীয় এলওসি ঋণের আওতায় পাওয়া যাবে ৭৩২ কোটি টাকা। আর সরকারী অর্থায়ন রয়েছে এক হাজার ১৮ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির সময়ও বেড়েছে ২ বছর। ফলে ২০২২ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ।
আশুগঞ্জ প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২ একর ভূমি অধিগ্রহণ। ৩৮টি কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্র ক্রয়ে ব্যয় হবে ১২৭ কোটি। কার্গো টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৭ কোটি টাকা। ১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অভ্যন্তরীণ ও পোর্ট ওয়াক রাস্তা তৈরি করা হবে। রেলওয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫২ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৮ সালে এক হাজার ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। ২০২১ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সাল পর্যন্ত। তবে প্রকল্পটিতে কয়েকটি নতুন কাজ যুক্ত করে পরামর্শক ও কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে।
তাছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ ও চূড়ান্ত নক্সা অনুযায়ী কাজের ধরন বেড়েছে। ফলে ৩৫ শতাংশ বা ৪৫৮ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। একই সঙ্গে মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হলেও তা আরও বাড়তে পারে বলে হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবনায়।
বারবার সময় বৃদ্ধির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান বলেন, প্রকল্পটি ভারতীয় ঋণের টাকায় হওয়ায় বিভিন্ন সময় নানা শর্তের পরিবর্তনের কারণে সময় লেগেছে। তাছাড়া করোনার কারণে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২ বছর মাঠে কাজ করতে না পারায় নক্সা প্রণয়নে সময় লেগেছে। তবে গত সেপ্টেম্বরে নক্সা চূড়ান্ত হওয়ায় সামনের ডিসেম্বর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হবে বলেও আশাবাদ প্রকাশ করেন নৌবাহিনীর এ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
এদিকে প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলছে, নতুন যেসব কাজ যুক্ত করা হয়েছে তা না করা হলে এটা থেকে তেমন ফল পাওয়া যেত না। তাছড়া বেতন-ভাতা ও পরামর্শক ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। নতুন সিডিউল অনুসরণ করায় ব্যয় বেড়ে গেছে।
প্রকল্পের নক্সা পরিবর্তন করায় চার লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়নে ব্যয় হবে ২৫ কোটি টাকা। আর যন্ত্রপাতির জন্য আরও ৫৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে।
বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণে ৪৬ কোটির কথা বলা হলেও এখন ব্যয় হবে ৬৮ কোটি টাকা। জেটি নির্মাণের জন্য ৫১ কোটি বরাদ্দ রাখা হলেও এখন ব্যয় হবে ৮৪ কোটি টাকা। কার্গো টার্মিনালের ব্যয়ও ৩৭ কোটি থেকে বেড়ে ১০৭ কোটি হচ্ছে। কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রে ৯৮ কোটি থেকে ব্যয় বাড়ছে ১২৭ কোটি টাকায়।
তাছাড়া প্রকল্পটি ভারতীয় ঋণের হওয়ায় এলওসি গাইডলাইন অনুযায়ী অবকাঠামো খাতের ৬৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। এখানে ৪০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের শুল্ক বাবদ ব্যয় হবে ২০৪ কোটি টাকার বেশি। যদিও ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি নির্ভরতা থাকায় এর আগে সরকার জনপ্রিয় ৫-জি প্রকল্প থেকে পিছিয়ে এসেছিল।