হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী :
মহানবী (সা.) ছিলেন মহান চরিত্রের অধিকারী আদর্শের জীবন্ত প্রতীক। আল-কোরআনই হলো তার জীবনাদর্শ। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন আল-কোরআনের মূর্ত প্রতীক’। তিনি তার জীবনে আল-কোরআনের প্রতিটি অনুশাসনের রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। এজন্য তাকে ‘জীবন্ত কোরআন’ও বলা হয়।
জন্মলগ্ন থেকেই তার মাঝে বিরাজ করছিল সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরী ও আদর্শ। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। বাল্যকাল থেকেই তার স্বভাব ছিল কলুষতা, কাঠিন্যতা ও কর্কশমুক্ত। নম্রতা ছিল তার প্রধান হাতিয়ার। তিনি ছিলেন দয়াশীল, সহনশীল ও সহানুভূতিশীল এবং সর্বমহলে বিশ্বস্ত।
ওয়াদা পূরণ বা অঙ্গীকার পালন করা রাসূল (সা.)-এর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার পালন না করাকে জঘন্যতম পাপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যে অঙ্গীকার পালন করে না তার ধর্ম নেই’। তাই তিনি নির্দেশ দেন, ‘তোমরা যখন অঙ্গীকার করবে, তখন তা পালন করবে’।
ব্যক্তিগতভাবে ওয়াদা-অঙ্গীকার পালনে তিনি ছিলেন নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল। তাইতো অল্প বয়সেই তিনি ‘আল আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হন। সাহাবি কবি হাসসান বিন সাবিত (রা.) রাসূল (সা.) সম্পর্কে আবৃত্তি করে বলেন, ‘আপনার চেয়ে সুন্দর আমার দু’চোখ কাউকে কখনো দেখেনি, আপনার চেয়ে সুন্দর সন্তান কোনো নারী কখনো জন্ম দেয়নি। আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সব দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত করে। হে আল্লাহ! আপনি যেমন চেয়েছেন ঠিক তেমন করেই তাকে সৃষ্টি করেছেন।’
কবির এই কবিতাই বলে দিচ্ছে কেমন ছিলেন তিনি। কেমন ছিল তার অনুপম আদর্শের সৌন্দর্য। অনুভব করার বিষয়। এজন্য তার উন্নত আদর্শের স্বীকৃতি দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’ (সূরা আল কলম : ৪)।
আল্লাহতায়ালা তাকে শুরু থেকেই সুন্দর ভূষণে নিরন্তর বিভূষিত করেছিলেন। অন্যায়ের প্রতিকার ও প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা আল বালা-মুসিবতে সহ্য ও স্থিরতা ছিল আখলাকে নববীর অনন্য ভূষণ। প্রত্যেক ধৈর্য ও সহনশীল লোকের জীবনবৃত্তান্ত খুঁজে দেখলে তাতে অব্যশই কোনো না কোনো বিকৃতি বা ফাঁকফোকর পাওয়া যাবে। কিন্তু এর বিপরীতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র মাধুরী ছিল এতটা সুনির্মল ও নির্ভেজাল যে, তার ওপর শত্রুদের পক্ষ থেকে জুলুমণ্ডঅত্যাচারের মাত্রা যতটা বেড়ে গিয়েছিল ঠিক তার সহিষ্ণুতা আর স্থিরতার চরম সীমাও ততটা বিরল ইতিহাসের জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল। আরবের মূর্খ মানুষগুলোর সীমা লঙ্ঘনের পরিধি যতটা বেড়েছিল তার সহনশীলতার পরিধিও ততটা বিস্তৃত হয়েছিল। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যেকোনো ক্ষেত্রে যখন রাসূল (সা.)-এর সামনে দুটি পথ খোলা থাকত তখন তিনি বারবার সহজ পথটিই অবলম্বন করতেন যতক্ষণ না গুনাহের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। কারণ যেকোনো গুনাহের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দূরে। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থে তিনি কখনো কারো থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর কোনো বিধান লঙ্ঘন করা হলে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতিশোধ নিতে দ্বিধায় ভুগতেন না’ (বোখারি শরিফ : ১/৫০৩)।
রাগ আর ক্রোধের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সংযমী। আর রাযি ও সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। রাগ শয়তানের কুমন্ত্রণার অংশ বিশেষ বলে তিনি কখনো রাগ করতেন না। এজন্যই তিনি এক আগন্তুককে উত্তম নসিহত হিসেবে বলেন, ‘রাগ করো না’। এমনটি তিনি তিনবার বলেছেন। (বোখারি শরিফ : ২/৯০৩)।
তবে পূর্বে যে বিষয়টি বলা হয়েছে, নিজের স্বার্থে তিনি কখনো কারো থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করা হলে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতিশোধ নিতে দ্বিধায় ভুগতেন না। তা আপন জায়গায় বহাল থাকবে। হযরত আয়েশা (রা.)- এর সূত্রে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) কখনো কাউকে মেরেছেন এমনটি হয়নি। নিজের স্ত্রীদের বেলায়ও না; এমনকি কোনো সেবক, কর্মচারীর ক্ষেত্রেও না। তবে জিহাদের ময়দানে আল্লাহর জন্য বেইমানদের ওপর আক্রমণ করেছেন। কেউ তাকে কষ্ট দিলে তিনি তার থেকে প্রতিশোধ নিতেন না। তবে শরিয়তের কোনো হুকুম লঙ্ঘন করলে দোষী হিসেবে তাকে শাস্তি দিতেন’ (সহিহ মুসলিম)। রাসূল (সা.)-এর বদান্যতা ছিল তার অন্যতম জীবনাদর্শ। দয়া ও দানশীলতা ছিল তার চরিত্রের ভূষণ। নিজের কাছে কিছু থাকলে তিনি কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না।
হযরত মুসা বিন আনাস (রা.) তার বাবা সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘রাসূল (সা.)-এর কখনো এমনি যে, কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছে আর তা তিনি দেননি। তিনি বলেন, একবার এক ব্যক্তি নবীজী (সা.)-এর কাছে একটি বকরি চাইলে তিনি তাকে এত বেশি পরিমাণ দান করলেন, যা দুই পাহাড়ের মধ্যস্থান পূর্ণ করে দেবে। অতঃপর লোকটি নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এসে বললেন, হে সম্প্রদায়! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো। কেননা, মুহাম্মদ (সা.) এত বেশি দান করেছেন যে, তিনি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ভয় করেন না’- (সহিহ মুসলিম)।
হযরত আনাস (রা.) বলেন, ‘লোকটি রাসূল (সা.)-এর কাছে শুধু দুনিয়াবি স্বার্থেই এসেছিল। কিন্তু সন্ধ্যা বেলা এমন অবস্থা সৃষ্টি হলো যে, রাসূল (সা.)-এর আনীত দ্বীন উক্ত ব্যক্তির কাছে পৃথিবী ও তার মধ্যকার সবকিছু থেকে শ্রেয়’- (মুসনাদে আহমাদ)।
কথাবার্তা, মত প্রকাশ ও কোনো কাজ করতে যাওয়ায় সাহসিকতা প্রদর্শন একটি চমৎকার গুণ। যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় তিনি ছিলেন সব মানুষের চেয়ে বেশি সাহসী। বীর সিপাহী হযরত আলী (রা.) বলেন, যখন যুদ্ধ শুরু হতো তখন আমরা রাসূল (সা.)-কে আড়াল নিয়ে আত্মরক্ষা করতাম। তিনি থাকতেন আমাদের মধ্য থেকে শত্রুদের সবচেয়ে নিকটবর্তী। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে উহুদ ও হুনাইনের যুদ্ধে।
নবীজী (সা.)-এর সর্বোত্তম আদর্শের অন্যতম ছিল তার লজ্জাশীলতা। লজ্জাশীলতা ছিল তার চরিত্রের এক মহান ভূষণ। লজ্জাশীলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ’। বস্তুত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিটি বাণী, কাজকর্ম, কথাবার্তা, আচরণ এবং তার জীবনের প্রতিটি ঘটনাও তৎপরবর্তী বিশ্ববাসীর জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, উৎকর্ষতম, অনুসরণীয় আদর্শ। একটি অনুপম আদর্শ ও চরিত্রের যতগুলো মহৎ গুণ প্রয়োজন, মানবহিতৈষী বিশ্বনেতা মহানবী (সা.)-এর চরিত্রে তার সবগুলোরই অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি তার উৎকর্ষতম আদর্শের মাধ্যমে বিশ্বমানবতাকে সত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছেন। তার অনুপম আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের শান্তির পতাকাতলে সমবেত হয়ে তার আদর্শে নিজেদের জীবনকে উজ্জ্বল করে গড়ে তুলেছিল। মানবজীবনের প্রতিটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি বিশ্বমানবতার জন্য শ্রেষ্ঠতম ও অনিন্দ্য সুন্দর অনুসরণীয় আদর্শ উপহার দিয়ে গেছেন যা প্রতিটি যুগ ও শতাব্দীর মানুষের জন্য মুক্তির দিশারী হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
উপরোক্ত আলোচনায় বর্ণিত নবীজী (সা.)-এর কয়েকটি বিশেষ গুণাবলি দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের অধিকারী। যার পক্ষে পবিত্র কোরআনুল কারিমও একই কথা বলেন। কিয়ামত পর্যন্ত যারা তার অনুসরণ করবে অবশ্যই তারা হেদায়েত পাবে। আর ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করবে। নবীজী (সা.)-এর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি আমাদের আছে। কেনইবা থাকবে না, তিনি সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরীর অধিকারী সুন্দরতম মানুষ ও রাসূল। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যেন উপরোক্ত আলোচনার প্রতি আমল করার তাওফিক দান করেন আমীন।
লেখক : সাবেক- ইমাম ও খতীব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট, প্রতিষ্ঠিতা সভাপতি জকিগঞ্জ উপজেলা সচেতন নাগরিক ফোরাম সিলেট, সভাপতি সিলেটস্থ দুধরচক ঐক্য সংগঠন।