ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত মেনেই পূর্বের ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে যোগদান করেছে চা শ্রমিকরা

7
চা শ্রমিকদের ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ।

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ‘আস্থা’রেখে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান ধর্মঘট ‘প্রত্যাহার’ করার ঘোষণা দিলেও অধিকাংশই সাধারণ চা শ্রমিকরা বাগানে কাজে যোগদান করেছে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু চা বাগানের চা শ্রমিকরা তা না মেনে ৩০০ টাকার মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন বলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে চা শ্রমিকনেতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজে যোগ দেয় চা শ্রমিকরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পূর্বের ১২০ টাকা মজুরিতেই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া, ভুরভুরিয়াসহ বেশ কয়েকটি চা বাগানের শ্রমিকেরা হতাশ হয়ে বাগানে কাচা চা পাতা উত্তোলন করছেন।
এদিকে বেলা সাড়ে ১১টায় কালিঘাট চা বাগানে বিক্ষুব্ধ চা শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করতে যান চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ কন্দ। চা শ্রমিকদের সাথে গত রবিবার রাতে সভার কথা বোঝাতে ও ধর্মঘট প্রত্যাহার করার কথা বলতে গিয়ে সাধারণ শ্রমিকরা তাকে লাঞ্ছিত করে। পরে দুপুর ১ টার দিকে কালিঘাট চা বাগান থেকে একাংশের চা শ্রমিকরা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে ফুলছড়া চা বাগান হয়ে ভাড়াউড়া চা বাগানে জড়ো হন তাঁরা।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার মৌলভী চা বাগান। শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও চা বাগান, মাইজদিহি চা, কালিঘাট চা বাগান।
কমলগঞ্জের মিরতিংগা চা বাগান, দেওড়াছড়া চা বাগান, শমশেরনগর চা বাগান, আলিনগর চা বাগান, ফুলবাড়ি চা বাগান, মাধবপুর চাবাগান।
কুলাউড়া উপজেলার কালিটি চা বাগান, গাজীপুর চা বাগান, রাঙ্গিছড়া চা বাগান, মেরিনা চা বাগান। জুড়ী উপজেলা ধামাই চা বাগানের চা শ্রমিকরাসহ বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন।
এছাড়া মনু ও ধলই ভ্যালীর সাধারণ সম্পাদক নির্মল দাস পাইনকা, পদ্ম চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি কৃষ্ণলাল দেশোহারাকে সাধারণ চা শ্রমিকরা উত্তোজিত হয়ে তাদেরকে লাঞ্ছিত করার খবর পাওয়া গেছে।
মনু ও ধলাই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি বলেন, ‘আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলে দিতে চাই, যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে থাকে তাহলে আমরাও স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাই। আমাদের কেন মানসিকভাবে নির্যাতন করছেন সবাই মিলে?।
এর আগে গত রবিবার রাত ৯টায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চা শ্রমিকনেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রেখে আগের ১২০ টাকা মজুরিতে কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। দুই পক্ষ যৌথ বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গত ২০ আগষ্ট মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কার্যালয়ে চা শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৪৫ টাকা। এরপর চলমান কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার কথা জানান, চা শ্রমিক নেতারা। কিন্তু সাধারণ চা শ্রমিকরা এই সিদ্ধান্ত না মেনে পুনরায় কর্মবিরতি পালনে আন্দোলন শুরু করে। ফলে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসে চা শ্রমিক ইউনিয়ন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটি অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের অভিভাবক। তিনি আমাদের যে সিদ্ধান্ত দিবেন আমরা তা মেনে নেব। তবে শ্রমিকরা বাগানে যথারীতি কাজ করে যাবে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা সোমবার সকালে কালের কন্ঠকে বলেন, আপাতত ১২০ টাকা মজুরিতে কাজে যোগ দেয় শ্রমিকরা। আমরা ১৪৫ টাকা মজুরি প্রত্যাখান করেছি। প্রধানমন্ত্রী

মৌলভীবাজার ডিসি অফিসে চা শ্রমিকদের সাথে বৈঠকের একাংশ।

আমাদের অভিভাবক। তিনি আমাদের যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে চা শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছে।
সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়. সেগুলো হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তাঁর সম্মানে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ২২ আগষ্ট থেকে কাজে যোগদান করবেন। আপাতত চলমান মজুরী অর্থাৎ ১২০/- (একশত বিশ) টাকা হারেই শ্রমিকগণ কাজে যোগদান করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে পরবর্তীতে মজুরীর বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনার পর চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে মর্মে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ দাবী জানান। আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হওয়ার জন্য চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ আবেদন করবেন যা জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থাপিত হবে। চা-শ্রমিকদের অন্যান্য দাবীসমূহ লিখিত আকারে জেলা প্রশাসকের নিকট দাখিল করবেন। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক দাবিকৃত কপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করবেন। বাগান মালিকগন বাগানের প্রচলিত প্রথা/দর মোতাবেক ধর্মঘটকালীন মজুরী শ্রমিকগণকে পরিশোধ করবেন।
এ সময় জরুরি সভায় মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, বিভাগীয় শ্রম দপ্তর উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম, চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ কন্দ, ভারপ্রপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দীসহ বিভিন্ন ভ্যালির সভাপতিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, চা শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরম শ্রদ্ধা করেন। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজকের এই সিদ্ধান্ত। চা শ্রমিকরা প্রধানমন্ত্রীর উপর আস্থা রেখে তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন এবং তারা কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রসঙ্গত. দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত ৯ অগাস্ট থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন দেশের ২৪১টি চা বাগানের প্রায় লক্ষাধিক চা শ্রমিক। প্রথম চার দিন শ্রমিকরা প্রতিদিন দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন। ১৩ আগষ্ট থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন শুরু করেন শ্রমিকরা। ১১ দিন পর গত ২০ আগস্ট শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠকে দৈনিক মজুরি ১৪৫ টাকায় রাজি হয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। কিন্তু আন্দোলনকারী শ্রমিকদের একটি অংশ তা প্রত্যাখ্যান করে রবিবার আবার আন্দোলনে নামেন। এই প্রেক্ষাপটে ওইদিন রাতেই আবার চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন।