জিলহজে¦র প্রথম দশ দিনের মর্যাদা ও ফজিলত

11

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

জিলহজে¦র এ প্রথম দশ দিনকে সামনে পাওয়া বান্দার জন্য আল্লাহর তরফ হতে এক মহা অনুগ্রহ। মুত্তাক্বী ও নেক বান্দাগণই এ দিনগুলোর যথার্থ মর্যাদা দিয়ে থাকেন। প্রত্যেক মুসলিমের উচিত সময় নামক এ মূল্যবান সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ণ করা, এ সুবর্ণ সুযোগকে হেলায় হারিয়ে না দেওয়া এবং যত্নের সাথে বিভিন্ন ইবাদত ও আনুগত্যেও মাধ্যমে এ দিনগুলোকে অতিবাহিত করা। জিলহজ¦ মাসের চাঁদ ওঠার পর তা দেখে প্রথমে এ দু’আটি পড়তে হবে- ‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হুম্মা আহিল্লাহু ‘আলায়না বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালা-মাতি ওয়াল ইসলামি ওয়াত তাওফীক্বি লিমা তুহিব্বু ওয়া তারদা। রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লা-হু। (অর্থাৎ, আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের উপরে চাঁদকে উদিত করুন শান্তি ও ঈমানের সাথে, নিরাপত্তা ও ইসলামের সাথে এবং ঐ সকল কাজের তাওফীক্বের সাথে যে সকল কাজ আপনি ভালোবাসেন ও পছন্দ করে থাকেন। (হে চন্দ্র!) আমাদের ও তোমার প্রভু আল্লাহ।) (দারেমী, আল-আযকার, পৃ. ৮২.; সনদ হাছান) এ দিনগুলোতে পালনীয় বড় বড় নেক আমল রয়েছে। একজন মুসলিম সেই আমলসমূহের সাহায্যে বড় পুণ্যেও অধিকারী হতে পারে। যেমন- উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা ঃ এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের মহত্ত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর, তাহমীদ, তাহলীল ও তাসবীহ পাঠ করা সুন্নাত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়িÑঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজারসহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে পাঠ করবে। আর এ তাকবীরের মাধ্যমে আল্লাহ্র ইবাদত প্রচারিত হবে এবং ঘোষিত হবে তাঁর অনুপম তা’যীম। এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যাতে তারা তাদের জন্য (এখানে রাখা দুনিয়া ও আখিরাতের) কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযক দান করেছেন, নির্দিষ্ট দিনগুলোতে তার উপর আল্লাহ্র নাম স্মরণ করতে পারে।’ [সূরা আল-হজ¦ (২২):২৮]
অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে, ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ বলতে এ আয়াতে ‘জিলহজে¦র প্রথম দশ দিন। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ হলো (জিলহজে¦র) দশ দিন এবং ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন’ হলো তাশরীকের কয়েকটি দিন। (সহীহ বুখারী, ২/৪৫৭) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট দিন’ অর্থাৎ তাশরীকের পূর্বের দিনগুলো, তারবিয়ার দিন এবং আরাফার দিন। আর ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন’ অর্থাৎ তাশরীকের দিনগুলো। আর এ মতই আবূ মূসা আশ’আরী মুজাহিদ, কাতাদা, আতা, সাঈদ বিন জুবাইর, হাছান, যাহহাক, আতা খুরাসানী, ইবরাহীম নাখয়ী হতে ইবনু কাসীর বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, ‘এ মত ইমাম শাফেঈর। আর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল হতে এটাই প্রসিদ্ধ। (তাফসীর ইবনু কাসীর, আযওয়াউল বায়ান, ৫/৪৯৭)
সুতরাং এ কথার ভিত্তিতে উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর যিকর (স্মরণ) করার অর্থ হবে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যে গবাদি পশু মানুষেল রুযীরূপে দান করেছেন তার উপর তাঁর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা (শুকরিয়া আদায় করা) এবং এতে তাকবীর ও কুরবানী যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেওয়া শামিল হবে। তাই আল্লাহর যিকর বলতে কেবল যবেহকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করাই নয়। কারণ হজে¦ কুরবানী যবেহ করার দিন ঈদের দিন হতেই শুরু হয়। (ফতোয়া ইবনু তাইমিয়াহ, ২৪/২২৫)। জিলহজে¦র প্রথম দশকের দিনগুলোতে পঠনীয় তাকবীর হলোÑ‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, ওয়ালিল্লা-হিল হাম্দ। এছাড়া অন্যান্যরূপেও তাকবীর পাঠ করার কথা জানা যায়। কিন্তু আমাদের জানা মতে রাসূল (সা.) হতে কোন নির্দিষ্টরূপ তাকবীর সহীহভাবে বর্ণিত হয়নি। যা কিছু এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে তা সবই সাহাবাগণের আমল। (ইরওয়াউল গালীল, ৩/১২৫)
ইমাম সানআনী বলেন, ‘তাকবীরের বহু ধরন ও রূপ আছে, বহু ইমামগণও কিছু কিছুকে উত্তম মনে করেছেন। যা হতে বুঝা যায় যে, এ বিষয়ে প্রশস্ততা আছে। আর আয়াতের সাধারণ বর্ণনা এটাই সমর্থন করে। (সুবুলুস সালাম, ২/১২৫) কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আজকে আমাদের সমাজে এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতটি পরিত্যাজ্য হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে, প্রথম দশ দিনে তো অল্প কিছু মানুষ ব্যতীত আর কারো নিকট হতে তাকবীর শুনাই যায় না। অর্থাৎ এ ফজিলতপূর্ণ আমল দেখা যায় না। তাই আমাদের উচিত হবে এ তাকবীর উচ্চস্বরে পাঠ করা, যাতে সুন্নাত জীবিত হয় এবং উদাসীনদের মনে সতর্কতা আসে। এভাবে এ সুন্নাতটির প্রচলন হবে। এতে তাকবীর বলার সওয়াব অর্জন হবে ও সাথে সাথে একটি মিটে যাওয়া সুন্নাত জীবিত করার সওয়াব পাওয়া যাবে। হাদিসে এসেছেÑ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার ইন্তেকালের পরে যে সুন্নাতটির মৃত্যু হয়েছে তা যে জীবিত করবে সে ব্যক্তি এ সুন্নাত আমলকারীদের সওয়াবের পরিমাণ সওয়াব পাবে এবং তাতে আমলকারীদের সওয়াবে কোন অংশ কম হবে না।’ (তিরমিজি, হাদীস নং ৬৭৭ ও ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২০৯, হাদিসটি সহীহ) পক্ষান্তরে এ কথা প্রমাণিত হয়, সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও আবু হুরাইরা (রা.) জিলহজ¦ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও (উচ্চস্বরে) তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন। (বুখারী, অধ্যায়) ‘‘আল্লাহর রাসূল (সা.) এর এই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। অর্থাৎ তাঁদের তাকবীর পড়া শুনে লোকেরা তাকবীর পড়তে হয় এ কথা স্মরণ করত এবং প্রত্যেকেই পৃথক পৃথকভাবে তাকবীর পাঠ করত। তাঁরা একত্রিতভাবে একই সুরে সমস্বরে তাকবীর পড়তেন না। কারণ, মনে রাখতে হবে উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ সুন্নাত। কিন্তু সকলে একই আওয়াজে জামাতের সাথে তাকবীর পাঠ করবে না। কারণ এটা বিদ’আত। যেমন একজন বলল, ‘আল্লাহু আকবার’। সকলে বলল: ‘আল্লাহু আকবার’। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) বা সাহাবায়ে কেরাম কখনো এরূপ করেননি। তবে সকলে একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজে তাকবীর পাঠ করতে পারবেন। তবে কাউকে তাকবীর শেখানোর জন্য এ রূপ করা হলে সেটা ভিন্ন কথা।
আমাদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে যে, আমরা কোন সুন্নাত আদায় করতে যেয়ে যেন বিদ’আতে লিপ্ত হয়ে না পড়ি। আল্লাহ্র রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে সুন্নাত সমূহ আদায় করেছেন আমাদের তেমনই করতে হবে। এটাই হলো আল্লাহ্র রাসূলের যথার্থ অনুসরণ। আমরা যদি সে সুন্নাত আদায় করতে গিয়ে সামান্যতম ভিন্ন পদ্ধতি চালু করি তাহলে তা বিদ’আত বলে গণ্য হবে। হাদিসে এসেছেÑ রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যার প্রতি আমাদের (ইসলামের) নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারী, হাদীস নং ২৬৯৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৮) যিলহজে¦র এ দিনগুলোতে সাধারণ তাকবীর ও তাসবীহ যেকোন সময়ে দিনে বা রাতে অনির্দিষ্টভাবে ঈদের সলাত পর্যন্ত পাঠ করতে হবে। আর নির্দিষ্ট তাকবীর যা ফরজ সালাতের জামা’আতের পর (একাকী) পাঠ করা হয় আর তা অহাজীদের (যারা হজে¦ গমন করেনি) জন্য আরাফার (৯ জিলহজ¦) দিনের ফজর থেকে এবং মক্কা শরীফে হাজীদের জন্য কুরবানীর দিনের যুহর থেকে শুরু হয় এবং তাশরীকের শেষ দিনের (১৩ যিলহজে¦র) আসর সলাত পর্যন্ত চলতে থাকে।
আল্লাহ তা’আলার যিক্র করা : এ দিন সমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে যিকরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, যেমন হাদিসে এসেছে- আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) বলেছেন, এ দশ দিনে (নেক) আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় কর। (মুসনাদে আহমদ-১৩২, হাদিসটি সহীহ)
বেশি করে নেক আমল করা ঃ নেক আমল সকল স্থানে ও সর্বদাই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের নিকট প্রিয়। তবে যিলহজে¦র এ বরকতময় দিনগুলোতে নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয়। তাই এ সময়ে কৃত নেক আমলের মর্যাদা ও সওয়াব অনেক বেশি। যারা এ দিনগুলোতে হজ¦ আদায়ের সুযোগ পেলেন তারা তো ভাগ্যবান, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর যারা হজে¦ যেতে পারেনি তাদের উচিত হবে এ বরকতময় দিনগুলোকে মর্যাদা দিয়ে বেশি বেশি করে সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত, যিক্র-আযকার, দু’আ-প্রার্থনা, দান-সদকা, মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক গভীর করা, সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় ও অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ প্রভৃতি ভাল করা সম্পাদন করা। যেমন ইতিপূর্বে হাদিসে আলোচিত হয়েছে যে বেশি বেশি করে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের বিশেষ মহব্বত অর্জন করা যায়। (আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে।) অন্ততপক্ষে এ দিনগুলোতে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর এ কথা স্মরণ করা উচিত, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামা’আতে আদায় করে অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহ্র যিকরে (তাসবীহ, তাহলীল, তিলাওয়াত, ইলম বা দ্বীনী আলোচনায়) বসে এবং তারপর দুই রাক’আত সলাত আদায় করে তবে এক হজ¦ ও উমরার সমপরিমাণ তার সওয়াব লাভ হবে।’ (তিরমিযী) আল্লাহ্র তরফ হতে বান্দার জন্য এটা এক সুবৃহৎ অনুগ্রহ এবং অতিশয় কল্যাণ। যার অনুগ্রহ ও করুণার শেষ নেই, যা চিন্তা ও ধারণার কল্পনা করা যায় না। একমাত্র তিনিই পুরস্কর্তা ও অনুগ্রাহী। তাঁর ইচ্ছামত তিনি যা দিয়ে, যাকে ইচ্ছা, যেকোন আমলের মাধ্যমে ইচ্ছামতো পুরস্কৃত ও অনুগৃহীত করে থাকেন। তাঁর ইচ্ছা ও আদেশ রুদ্দ করার কেউ নেই এবং কেউ তাঁর কল্যাণ ও অনুগ্রহকে রহিত করতে পারে না।
নিয়মিত ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া : ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ সময়মতো সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী (সা.)। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নাত, মুস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। হাদিসে এসেছেÑ আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোন অলির সঙ্গে শক্রতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরজ ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোন ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোন কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোন কাজ করতে চাইলে তাতে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা-সংকোচ করি মু’মিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৫০২)
এ হাদিসে কুদসীতে অনেকগুলো বিষয় আলোচিত হয়েছে। এর মাঝে একটি হলো, ফরজ ইবাদতসমূহ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আর নফল (যা ফরজ নয়) ইবাদত আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। যদি ফরজ ও নফল ইবাদতসমূহ যত্ন সহকারে যথাযথ নিয়মে আদায় করা যায়, তবে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিনের এমন নৈকট্য অর্জন করা যাবে যা তিনি এ হাদিসে উল্লেখ করেছেন। আমরা তার ইবাদতে কীভাবে যত্নবান হতে পারি এ সম্পর্কে এ হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফিজ ইবনে হাজার (রাহ.) বলেন, ‘ফরজসমূহ যত্নের সাথে আদায় করার অর্থ হলো আল্লাহ্র নির্দেশ পালন করা, তার নির্দেশকে সম্মান করা, মর্যাদা দেয়া, নির্দেশের সামনে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করা, আল্লাহ্র রবুবিয়্যতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার দাসত্বকে মনে প্রাণে মেনে নেয়া। আমলগুলো এভাবে যত্ন সহকারে আদায় করতে পারলে আল্লাহ্র সেই নৈকট্য অর্জন করা যাবে যা তিনি এ হাদিসে বলেছেন।’ (ফতহুল বারী) ফরজ-ওয়াজিবসমূহ যত্ন সহকারে নিয়মমাফিক আদায় করা এমন একটি গুণ যার প্রশংসা আল্লাহ তা’আলা তার কালামে করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এবং যারা নিজেদের সলাতে যত্নবান।’ [সূরা মা’আরিজ (৭০): ৩৪] তাই আসুন! আমরা এ পবিত্র দিনগুলোতে আল্লাহ্র ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের কর্মসূচী বাস্তবায়নের অনুশীলন করে অধিক সওয়াব ও প্রতিদান লাভ করতে চেষ্টা করি।
সিয়াম পালন করা : জিলহজে¦ও প্রথম নয়দিনে সিয়াম পালন করা মুসলিমের জন্য উত্তম। কারণ, নবী করীম (সা.) এ দিনগুলোতে নেক আমল করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর উত্তম সব আমলের মধ্যে সাওম অন্যতম; যা আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা’আলা নিজের জন্য মনোনীত করেছেন। যেমন- হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক কাজ তার নিজের কিন্তু সাওম আমারই জন্য এবং আমি নিজে তার প্রতিদান দেব। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১) প্রিয় নবী (সা.) ও এ নয় দিনে সিয়াম পালন করতেন। তাঁর পত্নী হাফসা (রা.) বলেন, নবী কারীম (সা.) কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হলোÑ আশুরার সওম, যিলহজে¦র দশ দিনের সওম, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের সওম ও ফজরের ফরযের পূর্বের দু’রাকাত সলাত। (আহমদ, ২৮৭/৬ সহীহ সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২১০৬, সহীহ সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং ২২৩৬) এ হাদিসে জিলহজে¦র দশ দিনের সাওম বলতে নবম তারিখ ও তার পূর্বের সাওম বুঝানো হয়েছে। কেননা, দশম দিন অর্থাৎ ঈদের দিনে তো সাওম পালন করা জায়েজ নেই। অপরদিকে বায়হাক্বী তাঁর ‘ফাযায়েলুল আওকাত’ গ্রন্থে বলেন, ‘এ হাদীসটি আয়েশা (রা.)-এর ঐ হাদীস অপেক্ষা উত্তম যাতে তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিলহজে¦র দশ দিনে সওম পালন করতে দেখিনি।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৭৬) কারণ, এ হাদীসটি ঘটনসূচক এবং তা আয়িশার ঐ অঘটনসূচক হাদীস হতে উত্তম। আর মুহাদ্দেসীনদের একটি নীতি এই যে, যখন ঘটনসূচক ও অঘটনসূচক দু’টি হাদীস পরস্পর বিরোধী হয়, তখন সমন্বয় সাধনের অন্যান্য উপায় না থাকলে ঘটনসূচক হাদীসটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ, কেউ যদি কিছু ঘটতে না দেখে, তবে তার অর্থ এটা নয় যে, তা ঘটেই নি। তাই যে ঘটতে দেখেছে তার কথাটিকে ঘটার প্রমাণস্বরূপ গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া, এ উক্তি সম্পর্কে ইমাম নববী (রাহ.) বলেন যে, আয়েশা (রা.) এর এ উক্তিটির ব্যাখ্যা রয়েছে। ব্যাখ্যা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোন অসুবিধার কারণে সওম পালন করেননি অথবা তিনি সওম পালন করেছিলেন কিন্তু আয়েশা (রা.) তা দেখেননি। আয়েশা (রা.) এর বক্তব্য দ্বারা যিলহজে¦র প্রথম নয় দিনে সাওম পালন না জায়েজ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। কারণ পূর্বে আলোচিত হাফসা (রা.) এর হাদিসটি মুসবিত তথা একটি আমলকে প্রতিষ্ঠিত করে। আর আয়েশা (রা.)-এর বক্তব্যটি একটি আমলকে নাফি (নিষেধ) করে। হাদিসশাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী যা মুসবিত (আমল প্রমাণ করে) তা নাফির উপর প্রাধান্য লাভ করে। (যাদুল মা’আদ: ইবনুল কায়্যিম) এ নিয়মানুযায়ী আমলের জন্য হাফসা (রা.)-এর হাদিস গ্রহণ করা হবে। মোটকথা, যিলহজ¦ মাসের এ নয় দিনে সিয়াম পালন করা মুস্তাহাব। ইমাম নব্বী (রাহ.) বলেন, ‘নবম তারিখে সওম পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব আমল।’ (শারহুন নব্বী, ৮/৩২০)
অপরদিকে রাসূলে কারীম (সা.) এ দশ দিনে সকল প্রকার নেক আমল পালন করতে উৎসাহিত করেছেন আর সাওম অবশ্যই নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। বরং নেক আমলসমূহের মাঝে সওম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন আমলট। হাদিসে এসেছেÑ সাহাবি আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমাকে এমন একটি আমলের নির্দেশ দিন যা শুধু আমি আপনার থেকে পাওয়ার অধিকারী হব। আল্লাহ্র রাসূল (সা.) বললেন, ‘তুমি সাওম (রোজা) পালন করবে। আর এর কোন নজির নেই।’ (হাকেম ও সহীহ সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ২১০০) তবে নাসাঈর আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে, আবু উমামা (রা.) বললেন, আমাকে একটি আমল সম্পর্কে নির্দেশ দিন। তিনি বললেন, ‘সওম পালন কর। এর সমকক্ষ কোন আমল নেই।’ তিনি আবারও বললেন, ‘আমাকে একটি আমল সম্পর্কে নির্দেশ দিন আর রাসূল (সা.) একই উত্তর দিলেন।’ এ হাদিস দ্বারা সাওম যে এক বড় মর্যাদাসম্পন্ন ও আল্লাহ্র কাছে প্রিয় আমল তা আমরা অনুধাবন করতে পারি।
কোন কোন দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের মাঝে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, যিলহজ¦ মাসের সাত, আট ও নয় তারিখে সাওম পালন করা সুন্নাত। কিন্তু সাওমের জন্য এ তিন দিনকে নির্দিষ্ট করার কোন প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। জিলহজে¦র ১ থেকে ৯ তারিখে যে কোন দিন বা পূর্ণ নয় দিন সাওম পালন করা যেতে পারে। তবে আরাফার দিন অর্থাৎ জিলহজ¦ মাসের নবম তারিখ সওম পালনের ব্যাপারে স্বতন্ত্র নির্দেশনা রয়েছে। হাদিসে এসেছেÑ সাহাবি আবু ক্বাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের সওম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৩) তবে জিলহজ¦ মাসের নবম তারিখে সওম পালন করবেন তারা যারা হজ¦ পালনে রত নন। যারা এ দিনে হজ¦ পালনে ব্যস্ত তাদের সওম পালন করা জায়েজ নয়। কেননা হাদিসে এসেছেÑ ইমাম আহমদ ইকরামা থেকে বর্ণনা করেন যে, (অসমাপ্ত)