মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অসহায় ও মানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন

13

মো: আবদুর রহমান জামিল :

৮ মে ২০১২ বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো : # মানবিক হও। রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জীন হেনরী ডুনান্ট এর ১৯৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ মে ২০১২ রবিবার বিশ্বব্যাপী রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে। ১৮২৮ সালের এই দিনে আর্ত মানবতার সেবায়মূর্ত প্রতীক শান্তিতে প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মহামতি জীন হেনরী ডুনান্ট সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। এ মনীষীর জন্মদিনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরন করার জন্যে দিনটিকে বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এর জন্ম হয়েছিল একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রের ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে। ১৮৫৯ সালের ২৪ জুন ইতালির উত্তর প্রান্ত সলফেরিনো নামক গ্রামে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে মানব ইতিহাসের একটি ভয়াবহ ও রক্তাক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে উভয় দেশের প্রায় ৩ লক্ষাধিক সৈন্য অংশগ্রহণ করে। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৫ ঘন্টাব্যাপি এ যুদ্ধে প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য আহত ও নিহত হয়েছিল। আহত সৈন্যরা বিনা চিকিৎসায় উন্মুক্ত প্রান্তরে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে সেবা ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে থাকে।
সেই সময় সুইজারল্যান্ডের এক তরুণ ব্যবসায়ী অর্থাৎ আজকের এ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা জীন হেনরী ডুনান্ট ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ানের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথে সলফেরিনো পৌঁছে যুদ্ধের মর্মান্তিক ও ভয়াবহ রক্তাক্ত দৃশ্য দেখে ব্যথিত হন। আহত সৈন্যদের অসহায় বেদনার্ত অবস্থা দেখে ডুনান্টের মনকে দুর্বল করে দেয়। তাই তিনি তার ব্যবসা সংক্রান্ত কর্মসূচি বাদ দিয়ে আহত সৈন্যদের সেবা-শুশ্রুষা করে বাঁচিয়ে তোলার জন্য মনস্থির করেন। তিনি ব্যবসায় খাটানোর টাকা স্বেচ্ছায় ঐ এলাকার আশে-পাশের গ্রামবাসীর সহায়তায় আহত সৈন্যদের ৬ দিনব্যাপি ফ্রান্সে “সারন্ডিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার ডিপার্টমেন্ট” এ স্থানান্তরিত করে সেবা-শুশ্রুষা করতে লাগলেন।
পরবর্তীতে যুদ্ধক্ষেত্রের মর্মান্তিক দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য ১৮৬২ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে অ গবসড়ৎু ড়ভ ঝড়ষভবৎরহড়” নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। বইটিতে তিনি বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানান এবং প্রস্তাব করেন :
১। স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন ও প্রশিক্ষণদান। ২। যুদ্ধাহতদের সেবা ও শুশ্রুষার জন্য প্রতিটি দেশে একটি সেবাসংস্থা গঠন। ৩। একটি অলঙ্ঘনীয় চুক্তির মাধ্যমে নতুন সংস্থার নিরাপত্তা বিধানকল্পে নীতিমালা প্রণয়ন। ৪। একজন যুদ্ধাহতকে সবসময় একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবগুলোর সার কথা ছিল আমরা কি পারি না, প্রতিটি দেশে এমন একটি সেবা সংস্থা গড়ে তুলতে যারা শত্রু মিত্র নির্বিশেষে আহতদের সেবা দিবে।
১৮৬৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে জীন হেনরী ডুনান্ট ৪ জন জেনেভাবাসী নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে যা কমিটি অব ফাইভ নামে পরিচিত। উক্ত কমিটি একই বছরের অক্টোবর মাসে ডুনান্টের প্রস্তাব সমূহ পর্যালোচনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে ১৬টি দেশের প্রতিনিধি যোগদান করেন। ১৮৬৩ সালের ২৬ হতে ২৯ অক্টোবর ৪ দিনব্যাপি এ সম্মেলনে ডুনান্টের প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনার মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং রেড ক্রস গঠিত হয়। রেড ক্রস গঠিত হবার পর কমিটি অব ফাইভ কে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটিতে রুপান্তরিত করা হয়।
রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এর ৭টি মূলনীতির রয়েছে সেগুলো হলোঃ মানবতা, পক্ষপাতহীনতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছামূলক সেবা, একতা ও সার্বজনীনতা।
এ সংস্থার সদর দপ্তর একমাত্র নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ড হলেও বিশ্বব্যাপি এর বিস্তার ব্যাপকভাবে লাভ করছে। সারা বিশ্বে প্রায় ১৯৬টি দেশ রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এর সদস্য। শুরুতে এ সংস্থার কাজ নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল যেমন আহতের সেবা ও শুশ্রুষা প্রদান করা। বর্তমানে এ সংস্থা সেবা ও শুশ্রুষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগসহ সমাজ উন্নয়নে ব্যপক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। যেমন ক) দুর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। খ) ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)। গ) স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম। ঘ) যুব রেড ক্রিসেন্ট সহ-শিক্ষা কার্যক্রম। ঙ) অনুসন্ধান কার্যক্রম। চ) রক্তদান কর্মসূচি। ছ) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। জ) রেড ক্রিসেন্ট নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রচার এবং প্রসার প্রভৃতি।
সারা দেশের ন্যায় সিলেট ইউনিটও ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আজীবন সদস্য সংগ্রহ করা, সিলেট রেড ক্রিসেন্ট মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, মিডওয়াইফারী প্রশিক্ষণ কোর্স, ডিপ্লোমা নার্সিং কোর্স, মুজিব জাহান রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্রের মাধ্যমে নিয়মিত রক্তদানে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, রক্ত সংগ্রহ, রক্ত পরীক্ষা, রক্তের উপাদান পৃথকীকরণ, সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে সরবরাহ, রক্ত পরিসঞ্চালন, থ্যালাসেমিয়া রোগীর সেবা দান, রক্ত বাহিত জীবানু দ্বারা আক্রান্ত রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান। এছাড়া যুব রেড ক্রিসেন্ট সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় সরকার অনুমোদিত সকল স্কুল ও কলেজে যুব রেড ক্রিসেন্ট দল গঠন, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সারা বছর অব্যাহতভাবে চলছে। ২০১৯ কোভিড ১৯ এ নিয়মিত টিকাদন কার্যক্রমে যুব স্বেচ্ছাসেবকরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে, কোভিড ১৯ পরিস্থিতে জনগণকে সচেতন করার জন্য মাইকিং, মাস্ক বিতরণ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরন করা হয়। সিলেট জেলায় কেন্দ্রিয় কারাগারে বিদেশী বন্দীদের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়। জাতীয় সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত ১৫০ প্যাকেট ইফতার সামগ্রী (তেল, লবণ, চিনি, খেজুর, মুড়ি, চিড়া, ছোলা, বেসন, সেমাই, সুজি, চানার ডাল) গরীব দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করা হয় ও শীতকালীন সময়ে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়।
সিলেট রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের ভাইস-চেয়ারম্যান মনসুজ্জামান চৌধুরী বাবুল ও সেক্রেটারি মোঃ আব্দুর রহমান জামিলের নেতৃত্বে এ অঞ্চলের মানুষ অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশী আস্থাশীল এবং রেড ক্রিসেন্ট সিলেট অঞ্চলের আজীবন সদস্যবৃন্দ নিজেদেরকে গর্বিত মনে করে। রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এর নীতিমালাসমূহ সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে পারলে এবং সকলে সচেতন হলে মানবিক মূল্যবোধ সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এ কার্যক্রমকে সকল স্তরে পৌঁছানোর জন্য সমাজের সকল স্তরের ব্যক্তিত্বদের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি।
আল্লাহ হাফেজ, রেড ক্রিসেন্ট দীর্ঘজীবী হোক।