কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুক্রবার ভোরে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুখোশ পরিহিত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় ৬ সাধারণ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন, মাদ্রাসার ৩ শিক্ষক ও ৩ ছাত্র। হামলায় আহত হয়েছেন আরও ১৫ রোহিঙ্গা। প্রত্যাবাসনে আগ্রহী এবং এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনার জের হিসেবে আরসা ক্যাডাররা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। উখিয়ার বালুখালী ময়নারঘোনা ১৮ নং ক্যাম্পে ভোরে একদল মুখোশ পরিহিত সন্ত্রাসী প্রথমে মাদ্রাসায় শিক্ষক-ছাত্রদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। প্রাণে বাঁচতে শিক্ষক ও ছাত্ররা সংলগ্ন মসজিদে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সন্ত্রাসীরা সেখানে মুহুর্মুহু গুলি চালায়। এর পাশাপাশি এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। হামলা থেকে কেউ কেউ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও মাদ্রাসার ৩ শিক্ষক ও ৩ ছাত্র ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। আহত হন আরও ১৫ রোহিঙ্গা। ভোর অনুমান ৪টার দিকে এ সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।
এদিকে এপিবিএন সূত্রে জানানো হয়েছে, ক্যাম্পের দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর এপিবিএন সদস্যরা অভিযান চালায়। উদ্ধার করে একটি শুটার গান, ৬ রাউন্ড গুলি এবং এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে।
এপিবিএন সূত্রে জানানো হয় নিহতরা হলেন ক্যাম্প ১২, ব্লক-জে-৫ এ আশ্রিত মাদ্রাসা শিক্ষক মোঃ ইদ্রিস (২৬) ক্যাম্প-৯, ব্লক-১৯ এর মৃত মুফতি হাবিবুল্লাহর পুত্র ইব্রাহিম হোসেন (২৪), ক্যাম্প-১৮, ব্লক এইচ-৫২ এর নুরুল ইসলামের পুত্র মাদ্রাসা ছাত্র আজিজুল হক (২২) আবুল হোসেনের পুত্র মোঃ আমীন (৩৩) ক্যাম্প-১৮, ব্লক এফ-২২-এর মোঃ নবীর পুত্র মাদ্রাসা শিক্ষক নূর আলম ওরফে হালিম (৪৫) ও এফডিএমএন ক্যাম্প ২৪-এর রহিম উল্লাহর পুত্র মাদ্রাসা শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫)।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আরআরসিসহ অনেকে।
সূত্র জানায়, যারা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী, প্রত্যাবাসনে জনমত গঠনে আর্মড পুলিশ তথা প্রশাসনকে যারা সহযোগিতা করছে এবং মসজিদ-মাদ্রাসায় মিয়ানমারে ফিরে যাবার পক্ষে যারা মতামত পেশ করছেন, তাদের নামের তালিকা তৈরির মাধ্যমে বাছাই করে তাদেরই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে আরসা ক্যাডাররা। উখিয়া টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে অধিকতর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ ও এপিবিএন যৌথ অভিযান শুরু করেছে।
উখিয়া থেকে সংবাদদাতা জানান, উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে রোহিঙ্গাদের। নিহতরা এ প্রতিহিংসার শিকার। মাদ্রাসায় পাঠদানকালে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার বিষয়ে আলোচনা করায় সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ আল-ইয়াকিন ক্যাডাররা শিক্ষক নূর আলম ওরফে হালিম ক্যাম্প-২৪-এর শিক্ষক হামিদুল্লাহসহ তিন শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ঘটনার খবর পেয়ে ময়নারঘোনা ক্যাম্প-১২ এর পুলিশ সদস্যরা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে। নিহতদের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে মর্গে পাঠানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ আর্মাড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পুলিশ সুপার শিহাব কায়সার জানান, শুক্রবার ভোর রাতে উখিয়া বালুখালী ক্যাম্প-১৮ এইচ-৫২ ব্লকে অবস্থিত দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায়। রোহিঙ্গাদের গোলাগুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ৬ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে হামলাকারীদের একজনকে একটি দেশীয় লোডেড ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরিসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। ঘটনার পরপরই ময়নারঘোনা পুলিশ ক্যাম্প-১২ এর পুলিশ সদস্যরা মাদ্রাসা ও আশপাশের এলাকায় ব্লকরেইড পরিচালনা করে আসছে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ৬ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির পর ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহ কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করেছে পুলিশ।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার পর ক্যাম্পে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং-১ (ইস্ট) লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৮ ব্লকে গুলি করে হত্যা করা হয় আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সংগঠনের চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহকে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করায় রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হত্যা করেছে মুহিবুল্লাহকে। সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা পুরনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ওইসময় আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে মিয়ানমার থেকে অন্তত সহস্রাধিক রোহিঙ্গা (আরএসও জঙ্গি) আফগানিস্তানে গমন করেছিল। সেখানে গেরিলাযুদ্ধে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা নিহত হয়। মারা যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে চট্টগ্রামে ও কক্সবাজারে এনআইডিধারী রোহিঙ্গাদের স্বজনরাও রয়েছে। তন্মধ্যে ইদ্রিছ জিহাদীর সহোদর ইউনুচ জিহাদী অন্যতম। প্রশিক্ষণ শেষে আফগানযুদ্ধে মারা যাওয়া রোহিঙ্গা জঙ্গি ইউনুচ জিহাদীর সহোদর এদেশের নাগরিক দাবিদার ইদ্রিস জিহাদী, ভয়ঙ্কর রোহিঙ্গা জঙ্গি শায়খ ছালামত উল্লাহ, মাস্টার আয়ুব, আবু সিদ্দিক আরমান, এনায়েত, নূর হোসেন, মৌলবি শফিক, আবুসিদ্দিক, রুহুল আমিনসহ এক শ্রেণীর রোহিঙ্গা নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে আরসার সঙ্গে। রোহিঙ্গা নেতা মৌলবি আবু সিদ্দিক আরমান, হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, শায়খ ছালামত উল্লাহ, হাফেজ হাসিম, বাইট্টা শামসু, মৌলবি শফিক, মৌলবি ইদ্রিস, চট্টগ্রামে বসবাসকারী ব্যবসায়ী নূর কামাল ও মৌলবি নূর হোছাইনসহ অনেকে তালেবান, হুজি, আল কায়েদা, আল্লাহর দল, আরএসও এবং আল-ইয়াকিন ক্যাডারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তাদের অর্থ যোগানদাতা বলে জানা গেছে। তারা প্রায় সময় সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিরোধী নানা অপকর্মে উস্কানি দিয়ে থাকে।
অভিজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মাটিতে বসবাস করছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। অথচ ওই রোহিঙ্গাদের যতই সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক না কেন, তারা কখনও বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলবে না। ক্যাম্পে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে পুরনো কিছু রোহিঙ্গা জঙ্গিকে গ্রেফতার করা দরকার। তারা (এনআইডিধারী) পুরনো রোহিঙ্গা। জঙ্গি মনোভাবের ওই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী নাগরিক দাবি করলেও কোন সময় এদেশের কোন উপকারে আসবে না। আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের এই ক্যাডাররা মৌলবাদী দলের পক্ষে সমর্থন করে থাকে। তারা সবসময় তাদের খোলস পাল্টাতে পারে। ক্যাম্পে প্রবেশ করলে তারা পুরনো রোহিঙ্গা এবং ক্যাম্পের বাইরে আসলে এনআইডি প্রদর্শন করে স্থানীয় নাগরিক বলে চলাফেরা করে প্রতিনিয়ত।