সুনামগঞ্জে বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে হালির হাওর

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সুনামগঞ্জের হাওরে হাওরে বাঁধ ভেঙ্গে ফসল ডুবির ঘটনা ক্রমে বেড়েই চলছে। শাল্লার মাউতির বাঁধের ক্লোজার দিয়ে হাওরে পানি প্রবেশে ক্ষত থাকতেই বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে ‘হালির হাওর’। অন্যদিকে টাঙ্গাইলে বংশাই নদীর আগাম জোয়ারের পানিতে ভলুয়া বিলে আবাদ করা শত শত কৃষকের আধাপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এদিকে নেত্রকোনায় খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে স্থানীয় পেটনা হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধ কেটে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সুনামগঞ্জের বড় হাওরগুলো মধ্যে হালির হাওর অন্যতম। যেখানে এ বছরও আবাদ হয়েছে সরকারী হিসাবেই ৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। এখন এর আশপাশের অন্যান্য হাওরও পড়েছে ফসল ডুবির হুমকিতে। এর পিছনে পিআইসির গাফিলতিকে-ই দায়ী করছেন স্থানীয় কৃষকরা। দায়সারাভাবে বাঁধ দেয়া এবং নির্মিত হাওর রক্ষা বাঁধে পাহারাদার না রাখায় এমন হয়েছে। এই ভাঙ্গনের প্রভাব পড়বে আশপাশসহ জেলা-উপজেলার হাওরগুলিতে। এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় কৃষকগণ। এখনও বেশির ভাগ বাঁধের কানায় কানায় পানি। যেসব হাওরে বাঁধ এখনও টিকে আছে সে বাঁধগুলোও ঝুঁকির মুখে। অনেক বাঁধেই উপচে কিংবা ভেঙ্গে পানি ঢোকার আশঙ্কায় কৃষক।
স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, উপজেলার আহসানপুর গ্রামের পাশে পাউবোর ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে হালির হাওরে পানি প্রবেশ করে সোমবার রাত ১২টার দিকে। উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের আহসানপুর এলাকার হেরাকান্দি গ্রামে ঢলের পানির চাপে ঝুঁকিতে থাকা বাঁধটি ভাঙ্গার জন্য কৃষকরা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও মনিটরিং কমিটির গাফিলতি রয়েছে বলে দোষাদোষী করছেন। তারা বলছেন, পাউবোর দুর্নীতি ও পিআইসির উদাসীনতা জায়েজ করতেই সুনামগঞ্জে একের পর এক ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলায় মোট ৩১টি বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি ঢুকছে। কৃষকরা এখন এই বাঁধ ভেঙ্গে ফসল হারানোকে নিজেদের নিয়তি মেনে নিচ্ছেন। ফলে কোন কাজেই আসছে না সরকারের ১শ’ ২২ কোটি টাকার বরাদ্দ দাবি হাওর আন্দেলনের নেতাদের। তারা বলেন, সময়মতো বাঁধের কাজ শুরু এবং শেষ না হওয়ায় ও সরকারী নীতিমালা উপেক্ষিত হওয়ার কারণে বাঁধ ভাঙ্গা তালিকা দিন দিন বড় হচ্ছে। হাওর বাঁচাও আন্দোলন জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটির দাবি এর দায় প্রশাসন ও পাউবোকেই নিতে হবে।
মির্জাপুরে ভলুয়া বিলের বোরো ধান পানির নিচে : টাঙ্গাইলের বংশাই নদীর আগাম জোয়ারের পানিতে ভলুয়া বিলে আবাদ করা শত শত কৃষকের আধাপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকের বছরের সবচেয়ে বড় আবাদের স্বপ্নের ফসল এখন পানির নিচে দোল খাচ্ছে। অসময়ে উজান থেকে আসা জোয়ারের পানি এবং বৃষ্টিতে বিলটির প্রায় ৩শ’ একর জমির বোরো ধান এখন পানির নিচে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক নিরুপায় হয়ে কোমর পানিতে নেমে তলিয়ে যাওয়া কাঁচা ও আধাপাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন।
জানা গেছে, উপজেলার আজগানা ইউনিয়নের ভলুয়া বিলটিতে আশপাশের গ্রাম বেলতৈল কুড়াতলী লতিফপুর ইউনিয়নের চাঁনপুর লতিফপুর ও তরফপুর ইউনিয়নের সিট মামুদপুর গ্রামের শত শত কৃষক প্রতিবছর বোরো আবাদ করে থাকেন। অন্য বছরের মতো এবারও তারা বোরো আবাদ করেছেন। নদীতে জোয়ার আসার আগে বৈশাখের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে ধান কেটে ঘরে তুলেন।
স্থানীয় কৃষকরা জানায়, এবছর বংশাই নদীতে অসময়ে জোয়ার এসে ভলুয়া খাল দিয়ে ভলুয়া বিলে পানি ঢুকেছে। দুদিনের ব্যবধানে বিলের শত শত একর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এই জোয়ারের পানিতে ওই অঞ্চলের শালিকমারা বিলে আবাদ করা বোরো ধানও তলিয়ে গেছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার ভলুয়া বিলে গিয়ে দেখা গেছে, তলিয়ে যাওয়া আধাপাকা বোরো ধান কোমর পানিতে নেমে কেটে ঘরে তোলার চেষ্ট করছেন। আজগানা ইউনিয়নের বেলতৈল গ্রামের কৃষক প-িত আলী বলেন, আমি ৬০ শতাংশ জমিতে ২৯ জাতের বোরো ধান আবাদ করেছি। বিলে পানি ঢুকে সব তলিয়ে গেছে। তিনি ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আধাপাকা ধান কেটে রোদে শুকাচ্ছেন। আজগানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সিকদার বলেন, বংশাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভলুয়া খাল দিয়ে ফসলের মাঠে ঢুকেছে। এছাড়া দুদিনের টানা বৃষ্টির ঢলের পানিতে পুরো এলকার বোরো ধান তলিয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিতে ধানের জমিতে পানি প্রবেশ করেছে। খবরটি জানার পর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে মাঠে পাঠিয়েছি। অনেক কৃষক ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন বলে তিনি জানান।
ফসল রক্ষা বাঁধ কেটে দিলেন আওয়ামী লীগ নেতা : নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হেকিমের বিরুদ্ধে স্থানীয় পেটনা হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধ কেটে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। নিজের জলমহালে নদীর মাছের প্রবেশ নিশ্চিত করতে তিনি রাতের আঁধারে বাঁধটি কেটে দেন। এ কারণে পেটনাসহ আশপাশের কয়েকটি হাওড়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (্ইউএনও) এএইচএম আরিফুল ইসলাম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত আভিযোগটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। জগন্নাথপুর গ্রামের কৃষকরা জানান, পেটনা এলাকায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লোকমান হেকিমের একটি জলমহাল (বিল) রয়েছে। এটি তিনি স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন। জলমহালটি মরাধনু নদীর পাশে অবস্থিত। ওই জলমহালে যাতে নদীর মাছ ঢুকতে পারেÑ সেজন্য তিনি সোমবার রাত ১০টার দিকে লোকজন নিয়ে বাঁধটি কেটে দিয়েছেন। এ কারণে বাঁধভাঙ্গা পানি এখন ফসলি হাওড়ের দিকে যাচ্ছে। কৃষকরা আরও জানান, বাঁধ কেটে দেয়ার খবরে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে লোকমান হেকিমকে ধাওয়া করেন এবং তার মোটরসাইকেলটি জলমহালে ফেলে দেন।
খালিয়াজুরীর ইউএনও এএইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকার কৃষকরা আমাকে রাতেই বিষয়টি জানিয়েছেন। তারা সাবেক চেয়ারম্যান লোকমান হেকিমের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করেছেন। আমরা উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে ও রাতেই বাঁধটি মেরামতের কাজ শুরু করেছি। এলাকার কৃষকরাও বাঁধটি রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। এখনও বাঁধটিতে কাজ চলছে।’
পাওবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত বলেন, ‘বাঁধটি গত বছরের পুরনো। কিন্তু শক্ত ছিল। মরা ধনু নদীর পাশের বাঁধ এটি। জলমহালে মাছ ঢোকাতে গিয়ে বাঁধটি ভেঙ্গে ফেলেছে। আমাদের কর্মচারী ও শ্রমিকদের কাজে লাগিয়েছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামত হয়ে যাবে।’