কাজিরবাজার ডেস্ক :
রেলওয়ের রানিং স্টাফদের আকস্মিক ডাকা ধর্মঘটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের প্রজ্ঞাপন বাতিলের আশ্বাসে দুপুরে রানিং স্টাফরা তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ও প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করেছে। এ ছাড়া বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে না এমন আশ্বাসে সারাদেশে রেল যোগাযোগ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটা থেকে বন্ধের পর বুধবার দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে সিলেটগামী পারাবত কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ট্রেনের চলাচল শুরু হয়। ধর্মঘটের কারণে সিডিউল বিপর্যয়ে পড়া ট্রেনগুলোর যাত্রীদের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। ঢাকার মতো সারাদেশেই যাত্রীরা টিকেটের বিপরীতে টাকা ফেরত পেয়েছেন।
জানা গেছে, ১৬০ বছরের পুরনো মাইলেজ সুবিধা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারির প্রতিবাদে রেলওয়ের রানিং স্টাফ (ট্রেন চালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিকেট পরিদর্শক (টিটি) ও শ্রমিক-কর্মচারীরা অঘোষিত ধর্মঘটে যান। মঙ্গলবার রাত ৩টা থেকে তারা সব ধরনের কর্মকা- বন্ধ করে দেন। সারাদেশে একযোগে রেল যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় নিয়মিত যাত্রীর সঙ্গে অফিসগামীরা বিপাকে পড়েন। তাদের ধর্মঘটে বুধবার সকাল ৬টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ১৮টি ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। তবে রেলের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ কারণে শিডিউল বিপর্যয় স্বাভাবিক। শিডিউল বুধবার বা বৃহস্পতিবারের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
বুধবার সকাল থেকে কোন ট্রেন ঢাকা ছেড়ে না যাওয়ায় যাত্রীরা স্টেশনে এসে ভোগান্তিতে পড়েন। আগামী তিনদিনের সরকারী ছুটির কারণে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষ, নিয়মিত যাত্রী এবং অফিসগামী যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে রানিং স্টাফদের কাজে ফিরিয়ে আনতে কমলাপুর স্টেশনে বুধবার সকাল সাড়ে নয়টার পরিস্থিতি সামাল দিতে আসেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। রেল সচিব হুমায়ুন কবীর ও রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার এই সময় তার সঙ্গে ছিলেন। শুরুতে রানিং স্টাফরা দাবি আদায়ে অটল থাকেন এবং মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে প্রথমে চাননি। পরে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রানিং স্টাফরা রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় রেলমন্ত্রীর আশ্বাসে রানিং স্টাফরা কাজে যোগ দেবেন বলে জানানো হয়েছিল। তবে স্টাফদের একাংশ ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে রেলমন্ত্রী জানান, আগামী ১৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকের সময় দিয়েছেন। আমি এবং রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। সেদিনের মধ্যে মাইলেজ সুবিধাসহ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আগে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো শ্রমিকরা পেত সেগুলো পুনরায় তারা ফেরত পাবেন।
এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন বাতিলের প্রতিশ্রুতি এবং বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে না, এমন আশ্বাসে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। এরপর ট্রেন চলাচল দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরপর ১টার পর একটা ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যায়। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্টেশন থেকেও ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছে।
রেলমন্ত্রী বলেন, আকস্মিক সকাল থেকেই আমাদের ট্রেন চলাচল বন্ধ। আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের যারা রানিং স্টাফ, তাদের কিছু দাবি-দাওয়া এবং একটি প্রজ্ঞাপন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করার কারণে তারা এই চরম কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। হঠাৎ করে ট্রেন চলাচল বন্ধের কারণ আমরা নিজেরাও জানি না, আমাদের আগে জানানো হয়নি। রেল বিভাগে যারা রানিং স্টাফ তারা রানিং এ্যালায়েন্স পেয়ে থাকেন। এ রানিং এ্যালায়েন্স পেনশনের সঙ্গে পরে যুক্ত হয়। এ সবই তারা পেয়ে আসছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুবিধাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে আগামী ঈদ-উল-ফিতরের আগে দেশের মানুষ যেন বিপদে না পড়ে, সেই বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে স্টাফদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রেলমন্ত্রী শ্রমিকদের অনুরোধ করে বলেন, ঈদের আগে যাত্রীদের যেন কোন ধরনের ভোগান্তির শিকার না হতে হয়, সেই বিষয়টি আপনাদের মাথায় রাখতে হবে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, সেটির জন্য রানিং স্টাফদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে না। পূর্বেও রেলকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তখন রেলকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। এখনও রেলকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সে সব ষড়যন্ত্রে রানিং স্টাফরা পা দেবেন না।
কমলাপুর রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল ৬টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ১৮টি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। এসব ট্রেনের যাত্রীরা যেতে পারেননি বলে তাদের টিকেটের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ব্যবস্থাপক মোঃ মাসুদ সারওয়ার বলেন, ঢাকা রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন ৭২টি ট্রেন সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। হঠাৎ ধর্মঘট থাকায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ১৮টি ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। এসব ট্রেনের টিকেট যাত্রীদের ফেরত দেয়া হচ্ছে। একইভাবে দেশের অন্যান্য স্টেশন থেকে টিকেটের টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে। কী পরিমাণ যাত্রী টিকেটের টাকা ফেরত নিয়েছেন, সেটির সঠিক তথ্য তিনি দিতে পারেননি।
রানিং স্টাফ শ্রমিক কর্মচারী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ সাইদুর রহমান বলেন, রেলমন্ত্রীর আশ্বাসের পর কর্মবিরতি করা শ্রমিকদের নিজ কাজে যোগ দেবেন। মন্ত্রীর আশ্বাসের পর সব কর্মচারীদের অনুরোধ করব এখন থেকেই নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য।
প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় : ট্রেনের চালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিকেট পরিদর্শকদের মূল বেতনের সঙ্গে রানিং এ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানের প্রস্তাব খারিজের আদেশ প্রত্যাহার করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বুধবার দুপুরে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত ১০ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয় রেলের রানিং স্টাফদের অবসর পরবর্তী সুবিধাগুলো পুনর্বহালের জন্য রেল মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ১০ এপ্রিলের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করে রেল মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জন্য কিছু তথ্য চেয়েছে।
উল্লেখ্য, রেলের রানিং স্টাফরা (ট্রেনচালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিটি) ১৬০ বছর ধরে মাইলেজ সুবিধা পাচ্ছিলেন। অর্থাৎ, দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের হিসেবে বাড়তি অর্থ পেতেন। এ ছাড়া, অবসরের পর বেসিকের সঙ্গে এর ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো। গত বছরের ৩ নবেম্বর এসব সুবিধা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরপর থেকে আন্দোলন কর্মসূচী চালিয়ে আসছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি। তবে গত ৩০ জানুয়ারি রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর কর্মসূচী স্থগিত করেন তারা।
গত ১০ এপ্রিল অর্থ বিভাগের এক আদেশে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মূল বেতনের সঙ্গে রানিং এ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানের প্রস্তাব খারিজ করে দেয়া হয়। এরপর হঠাৎ মঙ্গলবার রাত ৩টা থেকে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন তারা।