কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনও ঝুঁকি সীমার অনেক নিচে রয়েছে, ভবিষ্যতে ঋণের বর্তমান এই অবস্থান ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে ‘অফশোর ট্যাক্স এ্যামনেস্টি’ এবং ‘শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটের পটভূমিতে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা’ বিষয়ে উপস্থাপনা প্রত্যক্ষ করার সময় এই নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ বিভাগ ‘অফশোর ট্যাক্স এ্যামনেস্টি’ এবং ‘শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক উপস্থাপনা উপস্থাপন করে।
এ সময় শ্রীলঙ্কার চলমান সঙ্কটের কারণ ও এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা হয়। প্রায় সকল সূচকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে মর্মে মত প্রকাশ করা হয়।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ইত্যাদি অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ‘আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতি’ হিসেবে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে একটি সমন্বিত রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বড় কোন ঝুঁকির আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনও ঝুঁকি সীমার অনেক নিচে রয়েছে এবং এ ধারা সামনের সময়ে অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ প্রদান করেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর, অর্থ সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং ব্যাংকিং বিভাগের সচিব ড. অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হতে যাচ্ছে- এ ধরনের প্রচারণার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা দুঃখজনক। মঙ্গলবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলমান অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি ভিন্ন। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘খুব উষ্মার সঙ্গে বলতে হচ্ছে-আমরা এতবার প্রমাণ করেছি আমরা পারি এবং এরপরেও এই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তারা যে ভুল প্রমাণিত হয়েছেন, এজন্য তারা কতটুকু লজ্জিত হবেন? আমার শুধুমাত্র সেই প্রশ্নটা থাকা উচিত।’ ‘আমি বারবার বললাম, এটা হলে এই ভুল হচ্ছে, এই হচ্ছে, সেই হচ্ছে। আর প্রতিবারই যদি আপনি ভুল প্রমাণিত হন তাহলে তো আপনার লজ্জা পাওয়া উচিত।’
মুখ্য সচিব বলেন, দুঃখজনক বলতে পারেন। প্রায় এক যুগ আগে থেকে বাংলাদেশে একটা প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। হায় হায় একটা রব তৈরি করা। আহমদ কায়কাউস বলেন, যারা আজকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করছেন এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা থেকে বহু দূরে আছে। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করার মতো লজ্জাকর বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে নিয়েছেন জানান মুখ্য সচিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য উনি (প্রধানমন্ত্রী) আজ তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছেন। প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত উনি নিজে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীকে আগেও বলেছি বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি নিজে প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে নিশ্চিত হয়েছেন যে হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। তার আগে কিন্তু বলেননি। এটিই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বৈশিষ্ট্য।’
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, যারা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করে তারা বাংলাদেশকে হেয় করে। কোনভাবেই এটা তুলনা করার কোন কারণ নাই।
বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি ভিন্ন এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে অর্থ সচিব বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক যে ঋণ আছে তা জিডিপির মাত্র ১২ শতাংশ। যেটা শ্রীলঙ্কার হলো প্রায় ৪৮ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা যে ঋণটা করেছে বিদেশ থেকে তার সুদের হার হলো গড়ে ৭.৫ শতাংশ। আর আমরা যে বিদেশ থেকে ঋণ এনেছি তার সুদের হার হলো ১.৪ শতাংশ। এসব জিনিস থেকে আমরা বলতে চাচ্ছি যে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা দেশের সেটার সঙ্গে আমরা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান কারো সঙ্গে আমরা তুলনা করতে চাই না। আমরা মনে করি আমরা আমাদের নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছি।’
অর্থ সচিব বলেন, ‘একটা দেশ দেউলিয়া হয় কখন, যখন সে তার ঋণ শোধ করতে পারে না। আমাদের যে ঋণ আছে আগামী ৫-১০ বছরও আমরা যদি ধরি তাহলে ঋণ পরিশোধে কোন রকম কোন একটা ইনস্টলমেন্ট ফেইল করার কোন সম্ভাবনা আমাদের নাই।’
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমাদের দক্ষিণ এশিয়াতে চারটা বড় ইকোনমি। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ। চারটার তথ্য উপাত্ত যদি আপনারা দেখেন এখানে জিডিপিতে অবশ্যই ভারতের জিডিপি আমাদের চেয়ে বড়। দ্বিতীয় আমরা, তৃতীয় পাকিস্তান, চতুর্থ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জিডিপি যদি আপনি যোগ করেন বাংলাদেশের ডিজিপি তারচেয়ে বড়। বাংলাদেশ যে এক্সপোর্ট করে শ্রীলঙ্করা এবং পাকিস্তান যে এক্সপোর্ট করে এ দুটোর যোগফলের চেয়ে বেশি বাংলাদেশ এক্সপোর্ট করে। আপনি যদি বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ দেখেন সেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হলো পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার যে রিজার্ভ আছে এদের দুটোকে যদি যোগ করেন তার ডবল আমাদের কাছে আছে।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি যে আলাদা তার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে কথা বলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ।