বাংলাদেশ এখনও ঝুঁকিমুক্ত ॥ গত এক দশকে আড়াইগুণ বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা তাদের ৭০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের মূলে রয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে নেয়া অপরিকল্পিত বিদেশী ঋণ। এই অবস্থায় মঙ্গলবার নিজেদের ঋণখেলাপী ঘোষণা করেছে দেশটি। বাংলাদেশেও শ্রীলঙ্কার মতো অবকাঠামো খাতে বেশকিছু বড় প্রকল্প বিদেশী ঋণে বাস্তবায়ন চলছে। সতর্কতার কারণে শ্রীলঙ্কার প্রসঙ্গটি আলোচনায় উঠলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কোনভাবেই তুলনা চলে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রফতানি আয়, রেমিটেন্স পরিস্থিতিও শ্রীলঙ্কার তুলনায় অনেক ভাল অবস্থানে। গত এক দশকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিধি বাড়লেও তা পরিশোধে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে পাইপলাইনে বিদেশী ঋণ রয়েছে ৫০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের বড় অংশই বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার। চীন-রাশিয়ার ঋণ পাইপলাইনের মাত্র ২৫ শতাংশ। এই অবস্থায় বৈদেশিক ঋণে বাংলাদেশ এখনও ঝুঁকিমুক্ত বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণÑজিডিপির অনুপাত এখনও ২০ শতাংশের নিচেই রয়েছে।
আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ তলানিতে ঠেকায় ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে পারবে না বলে জানিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে দিয়ে মঙ্গলবার শ্রীলঙ্কা নিজেকে ঋণখেলাপী হিসেবে ঘোষণা দিল। এক বিবৃতিতে শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যেসব বিদেশী সরকার ও সংস্থা বিভিন্ন সময় শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছে, তারা চাইলে মঙ্গলবার থেকে সে ঋণকে ক্যাপিটালাইজ করতে পারে। অর্থাৎ, প্রাপ্য সুদের পরিমাণকে মূলধনের সঙ্গে যোগ করে দিতে পারে অথবা ঋণের অর্থ শ্রীলঙ্কান রুপীতে পরিশোধের বিকল্প বেছে নিতে পারে। জরুরী ভিত্তিতে পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শেষ হয়ে আসায় এই উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে দেশটির সরকার। এমন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মূলে রয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে নেয়া অপরিকল্পিত বিদেশী ঋণ। বাছবিচার না করে দ্বিপক্ষীয়ভাবে ধার নেয়া ও তা শোধ করতে না পারায় এখন দেউলিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে একসময়ের দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৬১ শতাংশেরও বেশি, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, কোন একটি দেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাতের ২০ শতাংশকে আদর্শ ধরা হয়। সেদিক থেকে জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশের বর্তমান ঋণ ১৬ শতাংশ। ঋণের এ অনুপাতই বলছে, শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক বেশি দৃঢ় ও স্থিতিশীল। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। প্রকল্প ঋণের জন্য কোন একক দেশ বা সংস্থার ওপর নির্ভরশীল নই আমরা। আমাদের ভাল রিজার্ভ রয়েছে। রফতানি আয়, রেমিটেন্স বাড়ছে। অপ্রয়োজনীয় বা কম প্রয়োজনীয় কোন প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে না। ঋণ ব্যবস্থাপনাও ভাল। তাই আমরা মনে করি বাংলাদেশের অবস্থা কখনই শ্রীলঙ্কা হবে না। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, আমরা যেখান থেকে যত ঋণ নিয়েছি, প্রত্যেকটা ঋণ সময়মতো পরিশোধ করেছি। যত রকমের দুর্দশা হোক, এমনকি এই করোনার মাঝেও ঋণখেলাপী হয়নি। যার কাছে যত ঋণ নিয়েছি, সেটা সময়মতো পরিশোধ করতে পেরেছি। এটা করে গেছি। সেদিক থেকে আমাদের রেকর্ড সব থেকে ভাল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই বিনিয়োগটাই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে আমার দেশ লাভজনক হবে। একটা বিনিয়োগ এলো, আর একটা বিশাল বিশাল কিছু তৈরি করে দিয়ে গেল, তো সেটা আমার কোন কাজে লাগল না। সেখানে আমরা একটু ধীরে চলি।
বিদেশী বিনিয়োগ নেয়ার ক্ষেত্রে এই সতর্কতা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, দেশের মানুষের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন হবে, সেই চিন্তাটা মাথায় রাখতে হবে। নইলে বিনিয়োগের জন্য যেভাবে সবাই ঝাঁপ দিয়ে আসছে; কিন্তু আমাদের খুব হিসাব করে পা ফেলতে হবে। এটা আমি সবাইকে খুব বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল এক বিলিয়ন ডলারের কম (৯৭ কোটি ডলার)। স্বাধীনতাউত্তর দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশ তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দাতাদের থেকে অনুদানই পেত বেশি। ফলে সে সময় বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বাড়ত খুবই ধীরগতিতে। এতে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় চার দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। পরের দশকে যদিও তা বৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে। পরের দশকে তা বৃদ্ধির হার কমে আসে। এতে ২০০০-০১ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১০-১১ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে। তবে গত এক দশকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হার দ্রুত বাড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে এর স্থিতি দাঁড়ায় ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক লাফে প্রায় আড়াইগুণ হয়ে গেছে। যদিও এর পুরোটাই সরকারের নিজস্ব ঋণ নয়। এর মধ্যে সরকারের বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ৫০ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। অবশিষ্ট ঋণের মধ্যে রয়েছে আইএমএফের বাজেট সহায়তা ও সরকারী বিভিন্ন সংস্থার ঋণ। এর মধ্যে বিদ্যুত খাতের জন্য নেয়া হয়েছে পাঁচ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, আইএমএফের দুই দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার, বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইন্সের উড়োজাহাজ কেনায় এক দশমিক শূন্য চার বিলিয়ন ডলার, বিসিআইসির সার কেনায় শূন্য দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিসির অপরিশোধিত তেল কেনায় শূন্য দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সাত বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছর দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছর বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৩৮ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। পরের তিন অর্থবছর তা আরও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৫১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছর ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক ঋণের এ দ্রুত বৃদ্ধি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পথে নিয়ে যাচ্ছে কি না- জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নানা অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রথমত, দেশটির সরকার অধিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক হারে কর হ্রাস করেছে। কিন্তু সরকারী ব্যয় নির্বাহের জন্য বিকল্প অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করেনি। এক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে নতুন করে ব্যাপক হারে নোট ছাপানো হয়েছে। এতে করে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এমন কিছু করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন ঝুঁকির মধ্যে নেই।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও জিডিপির অনুপাত কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইআরডির তথ্যমতে, স্বাধীনতাউত্তরকালে (১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর) বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল মাত্র সাত শতাংশ। তবে পরের কয়েক বছরে তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরেই দেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত ২৫ শতাংশ অতিক্রম করে। পরের দুই অর্থবছর তা আরও বেড়ে যথাক্রমে ৩২ ও ৩৩ শতাংশে পৌঁছে। তবে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে এ অনুপাত কমে ১৮ শতাংশে নেমে আসে। এর পর মোটামুটি উর্ধমুখীই ছিল দেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত। ১৯৯২-৯৩ ও ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। ওই দুই বছর এ অনুপাত ছিল ৪৫ শতাংশের ওপর। এর পর থেকে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত মোটামুটি নিম্নমুখী ছিল। এতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অনুপাতটি ১৩ শতাংশে নেমে আসে। পরের কয়েক বছর যদিও তা একটু একটু করে বাড়ছে। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশ অতিক্রম করে। আর সর্বশেষ অর্থবছর তা ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। মূলত মেগা বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ বৃদ্ধিকেই এজন্য দায়ী করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বর্তমানে পাইপলাইনে বিদেশী ঋণ রয়েছে ৫০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে পাইপলাইনে বিদেশী ঋণ সবচেয়ে বেশি জাইকার (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা)। সংস্থাটি আগামী কয়েক বছরে ৯৮৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার ঋণ দেবে বাংলাদেশকে, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। পাইপলাইনে থাকা ঋণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ রাশিয়ার। এর পরিমাণ ৭৮২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। দেশটি থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঋণ নেয়া হয়েছে। এটি মূলত কঠিন শর্তের ঋণ। পাইপলাইনে থাকা সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ বিদেশী ঋণ বিশ্বব্যাংকের। সংস্থাটির আইডিএ তহবিল থেকে আগামী কয়েক বছরে ৭৫৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৫ শতাংশ। এছাড়া ভারতের ঋণ আটকে রয়েছে ৬৫৮ দশমিক ২৯ কোটি ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৩ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। দ্বিপক্ষীয় হলেও এটি সহজ শর্তের ঋণ বলেই জানান ইআরডি সংশ্লিষ্টরা। পাইপলাইনে ঋণ আটকে থাকার দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটি আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশকে ৬০৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার ঋণ দেবে, যা পাইপলাইনের ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চীন। দেশটি বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশকে ৪৬৬ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ঋণ দেবে, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ ঋণ মূলত কঠিন শর্তের। এদিকে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে কয়েক বছরে বাংলাদেশ ঋণ পেতে যাচ্ছে ১৬৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের তিন দশমিক ২৫ শতাংশ। এটিও সহজ শর্তের ঋণ। এর বাইরে অন্যান্য উৎস থেকে কয়েক বছরে বাংলাদেশ ঋণ নিতে যাচ্ছে আরও ৬১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১২ দশমিক ২১ শতাংশ। এসব ঋণের প্রায় পুরোটাই সহজ শর্তের।
জানতে চাইলে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নমনীয় ঋণের পাশাপাশি বাংলাদেশ বর্তমানে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের মতো কঠিন শর্তের ঋণও নিচ্ছে। কাজেই শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধানতার সঙ্গে আগামী দিনে অগ্রসর হতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য-উপাত্ত নির্ভর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও দক্ষ বাজেট ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতে জোর দিতে হবে। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে কোন ধরনের ঝুঁকি নেই বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সংস্থাটির গত মাসে প্রকাশিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণের অভিঘাত (ডিসট্রেস) নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। একইভাবে সরকারের মোট ঋণের অভিঘাতও নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে স্বাধীনতার পর থেকেই পারদর্শিতা দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। শুধু ২০২০-২১ অর্থবছর ১৪১ দশমিক ৮৬ কোটি ডলার (প্রতিডলার ৮৬ টাকা ধরে যা ১২ হাজার ২শ’ কোটি টাকা প্রায়) আসল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।
একই সময়ে বৈদেশিক ঋণে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪৯ দশমিক ৬১ কোটি ডলার (৪ হাজার ২৬৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা প্রায়)। সব মিলিয়ে যা ১৬ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধের ধারায় উন্নয়ন সহযোগীরাও বাংলাদেশের প্রতি সব সময় ইতিবাচক।
ইআরডি সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ৭২ বিলিয়ন, পাইপলাইনে রয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (স্বায়ত্তশাসিত ছাড়া)। নানা উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ ও অনুদান দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। মোটা দাগে স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে মোট সাড়ে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করেছে। এর মধ্যে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঋণছাড় করেছে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি ঋণ এসেছে কমোডিটি এইড বাবদ। এরপর ১৮ বিলিয়ন ছাড় করেছে এডিবি। জাপানের ছাড় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে তুলনায় ঋণছাড়ের ধারেকাছে নেই চীন। এই সময়ে চীন ছাড় করেছে ৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪ বিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে ৩ বিলিয়ন, রাশিয়া ৩ বিলিয়ন ডলার, কানাডা ও জার্মানি সমান ২ বিলিয়ন ডলার করে, ইউনিসেফ দেড় বিলিয়ন, ভারত ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন, নেদারল্যান্ডস ১ বিলিয়ন, ডেনমার্ক ১ বিলিয়ন, সৌদি ১ ও সুইডেন ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণছাড় করেছে। এসব ঋণে উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়মিতভাবে সুদ ও আসল পরিশোধে সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ফলে উন্নয়ন সহযোগীরা সব সময় ঋণ নিয়ে ঘুরছে বাংলাদেশের পেছনে।
ইআরডি জানায়, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে যাচ্ছেতাই খরচ করেনি বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীরা প্রকল্পসহ উন্নয়নকাজ বাবদ ৭২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণছাড় করেছে। এসব ঋণের বিপরীতে স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ২০ দশমিক ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আসল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি পরিশোধ করেছে ৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সুদও। মূলত মেগা প্রকল্পের ব্যয় দুইভাবে মেটানো হয়- সরকারী অর্থায়ন ও ঋণসহায়তা। সরকার বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে অন্যতম পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের ব্যয়ভার মেটানোর জন্যই মূলত ঋণছাড়ও বেড়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে বৈদেশিক ঋণছাড় হয়েছিল ২৪ দশমিক ২৬ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মেগা প্রকল্পগুলো যত দ্রুত বাস্তবায়ন হবে তত দ্রুত বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ বাড়বে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমরা সব সময় বাস্তবতার নিরিখে প্রকল্প গ্রহণ করি। আবেগ দিয়ে কিছুই গ্রহণ করি না। আমাদের রেমিটেন্স ও রিজার্ভ ভাল। এসব কারণে বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ করে যাচ্ছি নিয়মিত। কখনও ফেল করিনি, এসব ক্ষেত্রে ফেল করবও না। আমরা বৈদেশিক ঋণ নিয়ে সব সময় সঠিক কাজে ব্যবহার করছি। ঋণ নিয়ে খেয়ে ফেলছি না, যার বড় কারণ নিয়মিত সুদ ও আসল পরিশোধ করে যাচ্ছি।