স্পোর্টস ডেস্ক :
রীতিমতো টালমাটাল, বেহাল, হতশ্রী দশা। আভিজাত্যের টেস্ট ক্রিকেটে কিছুতেই বুক চিতিয়ে লড়াই করতে পারছে না বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইতিহাস গড়ে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর অনেক আশা নিয়ে টেস্ট মিশন শুরু করেছিল টাইগাররা। কিন্তু দুই টেস্টেরই চতুর্থ ইনিংসে নির্লজ্জ ব্যাটিং ব্যর্থতার স্বাক্ষর রেখে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে সফরকারী বাংলাদেশ।
দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী দেখিয়ে সোমবার প্রায় দুইদিন বাকি থাকতেই পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে ৩৩২ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরেছে টাইগাররা। চতুর্থ ইনিংসে ৪১৩ রানের পাহাড়সম জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে মাত্র ৮০ রানে। এর আগে টস জেতা দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের প্রথম ইনিংসে অলআউট হয় ৪৫৩ রানে। জবাবে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস গুটিয়ে যায় ২১৭ রানে। ফলে প্রথম ইনিংসেই ২৩৬ রানে এগিয়ে যায় প্রোটিয়ারা। মুমিুনুল হকের দলকে ফলোঅনে ফেলানোর সুযোগ থাকলেও সেটা না করে আবারও ব্যাটিংয়ে নামে স্বাগতিকরা। এবার ৬ উইকেটে ১৭৬ রান করে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করেন আফ্রিকান অধিনায়ক ডিন এলগার। ফলে সব মিলিয়ে ৪১২ রানে এগিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। নিজেদের দ্বিতীয় ও টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য তাই বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৪১৩ রান।
বিশাল এই রানের জবাব দিতে গিয়ে প্রথম টেস্টের মতো পোর্ট এলিজাবেথেও (নতুন নাম গেবেহা) মুখ থুবড়ে পড়েন বাংলার ব্যাটাররা। ১৩৩ বছরের পুরনো স্টেডিয়াম সেন্ট জর্জেস পার্কে নিজেদের অভিষেক ম্যাচে আসা-যাওয়ার মিছিলে ব্যস্ত থাকেন টাইগার ব্যাটাররা। জঘন্য ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী রেখে ২৩.৩ ওভারে মাত্র ৮০ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। এটি টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বনিম্ন দলীয় রান। দলের পক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২৭ রান করেন লিটন দাস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০ রান করেন অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ। ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের ব্যাট থেকে আসে ১৩ রান। বাকি আট ব্যাটারের কেউই দুই অঙ্কের কোটা স্পর্শ করতে পারেননি। এর মধ্যে পাঁচজনের নামের পাশে ০ (শূন্য) রান। এরা হলেন- প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকানো মাহমুদুল হাসান জয়, ইয়াসির আলী রাব্বি, তাইজুল ইসলাম, খালেদ আহমেদ ও এবাদত হোসেন। এবাদত অবশ্য গর্ব করতে পারেন তিনি কোন বল না খেলেই শূন্য রানে অপরাজিত থাকেন! বাকিদের মধ্যে নাজমুল হোসেন শান্ত ৭, মুমিনুল হক ৫ ও মুশফিকুর রহিম করেন ১ রান। অবশিষ্ট ৭ রান আসে অতিরিক্ত থেকে।
ডারবানের কিংসমিডে প্রথম টেস্টে ২২০ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। তবে ওই টেস্টে প্রথম চারদিন অনেকটা সমানতালে লড়াই করেছিল মুমিুনুল হকের দল। কিন্তু শেষ দিনে মাত্র ৫৫ মিনিটেই মুড়িমুড়কির মতো ঝড়ে পড়েছিল টাইগার ব্যাটিং। যে কারণে মাত্র ৫৩ রানে অলআউটের লজ্জায় ডুবতে হয়েছিল। যা টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ইনিংস। এবার পোর্ট এলিজাবেথে শুরু থেকেই খাবি খেয়েছেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। তবে প্রথম টেস্টের চতুর্থ ইনিংসের মতো এই টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে অনেকটাই মিল আছে। ডারবানে পঞ্চম দিনে মাত্র ৫৫ মিনিটে গুটিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এবার পোর্ট এলিজাবেথে চতুর্থ দিনে নিজেদের ইনিংস শেষ করেছে ৫৯ মিনিটে! দ্বিতীয় ইনিংসে সব মিলিয়ে ২৩.৩ ওভার ব্যাট করে ৮০ রানেই অলআউট হয়েছে মুমিনুলের দল। এর মধ্যে চতুর্থ দিনে ব্যাট করেছে মাত্র ১৪.২ ওভার। এই সময়ে ৫৩ রান তোলার পথে হারিয়েছে বাকি ৭ উইকেট।
প্রথম টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই স্পিনার কেশভ মহারাজ আর সাইমন হারমার মিলে শেষ করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ইনিংস। দুই স্পিনার দিয়ে আক্রমণ সাজানো দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যবহার করতে হয়নি আর কোন বোলার। দ্বিতীয় টেস্টেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। টানা দুই টেস্টে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস গুঁড়িয়ে দিয়েছেন মহারাজ আর হারমার। অন্য কোনো বোলার ব্যবহার করতে হয়নি প্রোটিয়া কাপ্তান ডিন এলগারকে। ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে টানা দুই টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ৭ উইকেট করে নিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার মহারাজ। আর অফ স্পিনার হারমার প্রথম টেস্টের মতো এবারও নিয়েছেন ৩ উইকেট। আগের টেস্টের চতুর্থ ইনিংসের চেয়ে এবার উন্নতির দাবি করতে পারে বাংলাদেশ! ডারবানে ১৯ ওভারে ৫৩ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল দল। এবার সাড়ে চার ওভার বেশি খেলে ২৭ রান বেশি করেছে! ২০০৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরের পর এই প্রথম টানা দুই টেস্টে এক শ’র নিচে গুটিয়ে যাওয়ার লজ্জায় ডুবতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
রবিবার তৃতীয় দিন শেষে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেট হারিয়ে ২৭ রান করেছিল বাংলাদেশ। বিশাল লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা টাইগাদের হার তখনই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। সোমবার চতুর্থ দিনে গুরুদায়িত্ব ছিল দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার মুশফিকুর রহিম ও অধিনায়ক মুমিনুল হকের ওপর। কিন্তু মহারাজের করা দিনের দ্বিতীয় ওভারেই প্রথম সিøপে ধরা পড়েন দলের অভিজ্ঞতম ব্যাটার মুশফিক। আউট হওয়ার আগে তার ব্যাট থেকে আসে মাত্র ১ রান। এরপর বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি মুমিনুল ও ইয়াসির আলী রাব্বিও। মহারাজের চতুর্থ শিকারে পরিণত হওয়ার আগে ৫ রান করেন মুমিনুল। অন্যদিকে, ইয়াসির শূন্য রানে আউট হন সাইমন হারমারের প্রথম শিকারে পরিণত হয়ে। সপ্তম উইকেটে ইনিংসের সর্বোচ্চ ২৫ রানের জুটি গড়েন লিটন দাস ও মেহেদি হাসান মিরাজ। ইনিংসের সর্বোচ্চ ২৭ রান করা লিটনকে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন মহারাজ। এরপর উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে তার ষষ্ঠ শিকারে পরিণত হন ২০ রান করা মিরাজ। স্বীকৃত সব ব্যাটারদের উইকেট তুলে নিয়ে জয়ের জন্য আর বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি প্রোটিয়াদের। স্কোরবোর্ডে কোন রান যোগ না করেই শেষ ৩ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
মহারাজ ১২ ওভার বোলিং করে ৪০ রান খরচায় ৭ উইকেট কব্জা করেন। আর হারমার ১১.৩ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে বাকি ৩ উইকেট দখল করেন। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এ দুজন মিলেই বাংলাদেশের সবকটি উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়েছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রথম টেস্টের চতুর্থ ইনিংসেও মহারাজ ৭ ও হারমার ৩ উইকেট পেয়েছিলেন। অসাধারণ বোলিংয়ের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৮৪ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন মহারাজ। আট নম্বরে নেমে তার এই রান প্রোটিয়াদের চালকের আসনে পৌঁছে দেয়। এরপর বল হাতে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট লাভের পর দ্বিতীয় ইনিংসে আরেকবার ৭ উইকেট দখল করেন। ফলস্বরূপ অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ম্যাচসেরা হয়েছেন কেশভ মহারাজ। একইভাবে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন তিনি।
সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হককে বেশিরভাগ কথা বলতে হয়েছে মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে। অভিজ্ঞ এই ব্যাটারের বারবার রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে দলকে ডোবানো নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে মুমিনুল বলেন, এই শট মুশফিক ভাই খেলতেই পারেন। তার গেম প্ল্যানে যদি থাকে এটা খেলবেই। এমন না যে, এটা খেলে রান করেননি বা খুব অসফল। আমার মনে হয়, তাকে সাপোর্ট করা উচিত। এই শট খেলে তিনি কিন্তু সফল। আপনিও দেখেছেন, আমিও দেখেছি। আমি আপনাদের অনুরোধ করি, আপনারা অনুরোধ মানলে বাংলাদেশ দলের জন্য ভাল। আপনারা জিনিসটা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা করতে থাকলে, অনেক বেশি বলতে থাকলে ভাইয়ের জন্য খারাপ, দলের জন্য খারাপ, দেশের জন্যও খারাপ। রিভার্স সুইপ তো ক্রিকেটেরই একটা শট, তাই না? ক্রিকেটের বাইরের কোন শট তো না?