কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে মাত্র করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই কমছে মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা। টানা কয়েকদিন মৃত্যুশূন্য ছিল ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে। কিন্তু এরইমধ্যে নতুন করে শঙ্কা জাগাচ্ছে ডায়রিয়া। রাজধানীর নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী। রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে জায়গা দেয়া যাচ্ছে না রোগীদের। এক রোগীর সুস্থতার বিপরীতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ঃ ২০ জন রোগী আসছে ভর্তি হতে। হঠাৎ করে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বায়ু দূষণ, অনিরাপদ পানি এবং অনিয়ন্ত্রিত মেগা প্রজেক্টগুলোকেই দুষছেন। এসব নির্মাণাধীন মেগা প্রজেক্ট থেকে ধুলোবালি ছড়াচ্ছে সারা শহরে। বায়ু দূষণের পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে খাবারও। আর ওয়াসার দূষিত পানি তো রয়েছেই। তাই সুস্থ থাকার জন্য নিজের সচেতনতার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ মার্চ প্রথম হাসপাতালটিতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি ১ হাজার ছাড়ায়। এদিন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মোট রোগী ভর্তি হন ১০৫৭ জন। এর পরেরদিন ১৭ মার্চ রোগী ভর্তি হয় ১ হাজার ১৪৭ জন। ১৮ মার্চ রোগীর পরিমাণ আরও বাড়ে। এদিন মোট রোগী ভর্তি হয় ১ হাজার ১৭৪ জন। একইভাবে ১৯ তারিখে রোগী ভর্তি হয় ১ হাজার ১৩৫ জন, ২০ তারিখে ১ হাজার ১৫৭ জন। ১২শ’ রোগী ভর্তি ছাড়ায় ২১ মার্চ। এদিন মোট রোগী ভর্তি হয় ১ হাজার ২১৬ জন। এরপরের দিনও ১ হাজার ২৭২ জন রোগী ভর্তি হয়। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে ২৩ মার্চও। এদিন নতুন রোগী ভর্তি হয় ১ হাজার ২৩৩ জন। ২৪ মার্চ কিছুটা কমলেও ১১শ’ ঘরেই থাকে রোগী ভর্তি। এদিন নতুন রোগী ভর্তি হয় ১ হাজার ১৭৬ জন। ২৫ মার্চ ভর্তি হয় ১ হাজার ১৩৮ জন, ২৬ মার্চ ১ হাজার ২৪৫ জন, ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৩০ জন। সোমবার রোগীর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩৩৪ জনে। যা আইসিডিডিআরবির ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি। মঙ্গলবারও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। এদিন দুপুর দুইটা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি হয় ৭৬৯ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকার বয়স্ক মানুষই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে হাসপাতালে আসছে। তাদের সুস্থ হতে যেমন সময় লাগছে তেমনি মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশ বায়ু দূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। এরইমধ্যে রাজধানীতে চলছে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ। যেগুলোর নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত সামগ্রীর কণাগুলো বায়ুতে মিশে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে হোটেল-রেস্তরাঁর খোলা খাবারগুলো দূষিত হচ্ছে। করোনার কারণে গত দুই বছর আমরা যেমন নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করেছি এখন হঠাৎ করে আবার সব উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় বাইরের খাবারও আমাদের বেশি খাওয়া হচ্ছে। এছাড়া তীব্র গরমে রাস্তার শরবতও পান করতে দেখা যাচ্ছে অনেককে। যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আর ওয়াসার বিরুদ্ধে তো একটা অভিযোগ বরাবরই রয়েছে যে তারা আমাদের অনিরাপদ পানি সরবরাহ করে থাকে। যার থেকে শুধু ডায়রিয়া কেন অন্যান্য বড় ধরনের অসুখেরও সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, এসবের বাইরেও আমরা অনেক ডায়রিয়া রোগী পাচ্ছি যারা পোস্ট কোভিডের নানা জটিলতায় ভুগছেন। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নিজের সচেতনতার বিকল্প নেই।
সরেজমিনে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই দূষিত পানি পান করেই ডয়ারিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তাদের অভিযোগ ওয়াসার পানি পান করে এই সমস্যা হয়েছে। তবে ওয়াসার পানি খেয়েই এমনটি হচ্ছে কি না বিষয়টি গবেষণার প্রেক্ষিতেই বলা যাবে উল্লেখ করে হাসপাতালের প্রধান ডাঃ বাহারুল আলম বলেন, ডায়রিয়া একটি পানিবাহিত রোগ। ইনজেকশন বা রক্তের মাধ্যমে রোগটির জীবাণু শরীরে যাবে না। এটা পানির মাধ্যমে মুখ দিয়েই শরীরে যাবে। যেকোন উপায়ে তারা দূষিত পানি খেয়েছে। সেটা ওয়াসারও হতে পারে বা অন্য কোন কারণেও দূষিত হতে পারে। এটি বের করা গবেষকদের কাজ। আমাদের কাছে রোগী আসছে। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর আগে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের কারণ হিসেবে আমরা দেখেছি অনেক সময় খাওয়ার পানির ও স্যুয়ারেজ লাইন এক হয়ে যায়। মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন বা পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পানির সাপ্লাইলাইন চেক করা উচিত। কোন রকম ত্রুটি পেলে সেটা মেরামত করতে হবে। তিনি বলেন, এখানে আসা বেশিরভাগ রোগীই তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে আসছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তার পানিশূণ্যতা দূর না করলে মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এক্ষেত্রে ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা দিলেই খাবার স্যালাইন বা ঘরে তৈরি চিনি-লবণের পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, করোনার কারণে গত দুইবছর বেশিরভাগ মানুষই ঘরে সময় কাটিয়েছে। এখন আবার জীবন-যাপন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। স্কুল-কলেজ খুলছে। তীব্র গরমের পাশাপাশি বাড়ছে বায়ু দূষণও। তাই ডায়রিয়া বা পানিবাহিত রোগগুলো বাড়ছে। এর থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই খাবার পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। রান্না করা খাবার বেশিক্ষণ ফ্রিজের বাইরে রাখা যাবে না। তাহলে গরমে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিম্ন আয়ের মানুষ যারা বিশুদ্ধ পানি পান না তাদেরও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
তবে স্বস্তির কথা আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল ছাড়া অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়ার রোগীর চাপ কম। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, আমাদের এখনও খুব একটা রোগী বাড়েনি। সামান্য বেড়েছে। গত সপ্তাহে ৮, ১০, ১১, ১২, ৭ জন এ রকম রোগী এসেছে। ৬৭৩ বিছানার মধ্যে এই সংখ্যক রোগী স্বাভাবিকই বলা চলে। ডায়রিয়া খাবার ও পানিবাহিত রোগ। গরমে খাবার অল্প সময়েই নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও গরমের সময় বাড়ে। সেজন্য ডায়রিয়া বাড়ছে। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, আমার পরামর্শ হলো, খোলা খাবার না খাওয়া, হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধোয়া, বাচ্চার মা-বাবা যেন বাচ্চাকে পরিষ্কার করার সময় সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেন, ওদের জন্য খাবার তৈরির সময় সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নেন। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। রাস্তার ফুচকা, চটপটি, ভেলপুরি বা ডালপুরি এগুলো পরিহার করতে হবে।
আইসিডিডিআরবি জানায়, রাজধানীর চার এলাকার রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে এখানে। যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শনিরআখড়া ও দক্ষিণখান এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে। তবে বৃষ্টি হলেই এ পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হবে উল্লেখ করে ডাঃ বাহারুল আলম বলেন, এখন যে গরম তাতে ব্যাকটেরিয়া প্রজনন বা বংশবৃদ্ধিতে খুব উৎসাহিত হয়। রোগ ছড়ানোর অনুকূল পরিবেশ পায়। একটা বৃষ্টি হলেই ডায়রিয়া অনেক কমে যাবে। এখন ৩২-৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা। এই পরিবেশ ব্যাকটিয়ার জন্য খুবই সহায়ক। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা ২৪-২৭ তাপমাত্রায় নেমে আসবে। তখন রোগীর সংখ্যাও অর্ধেকে নেমে আসবে।