ইউক্রেনের পাঁচ শহরে মানবিক করিডর চালু ॥ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে একচুলও নড়ানো যাবে না- মস্কো

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের ১৩তম দিনে মঙ্গলবার দেশটির পাঁচ শহরে মানবিক করিডর চালু করেছে মস্কো। অবরুদ্ধ কিয়েভ, সুমি, মারিয়াপোল, খারকিভ ও চেরনিহিব থেকে এদিন হাজার হাজার ইউক্রেনীয় নিরাপদে চলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে আসেন। কয়েক দিনের টানা রুশ হামলায় শহরগুলোর বহু মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। হামলার পর এ পর্যন্ত অন্তত ২০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে বলে জাতিসংঘ জানায়। এদিকে ইউক্রেনে রুশ হামলার ফলে মস্কোকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে পশ্চিমারা। মঙ্গলবার পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ২৭৭৮টি নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার দিক থেকে ইরান ও সিরিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে দেশটি। সর্বোচ্চ নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা দেশগুলোর তালিকায়ও এখন শীর্ষে রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন ওয়েবসাইট কাস্টেলাম এ তথ্য প্রকাশ করে। তবে মস্কো সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নিষোধাজ্ঞা দিয়ে তাদের লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়ানো যাবে না।
মঙ্গলবার মস্কো জানায়, পশ্চিমারা রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে। রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক বলেন, রাশিয়ার তেল আমদানি করতে কোন ধরনের অস্বীকৃতি বিশ্ববাজারের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে। রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্বিগুণের বেশি হবে। ইউক্রেন আক্রমণের শাস্তি হিসেবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ওপর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার এমন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জোটের দেশগুলো তাদের মোট চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাস ও ৩০ শতাংশ তেল আমদানি করে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হলে ইউরোপের হাতে সহজ কোন বিকল্প নেই। রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ইউরোপের বাজারের জন্য রাশিয়ার তেলের বিকল্প খুব দ্রুত বের করা অসম্ভব।
ওদিকে ইউক্রেন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক আখ্যায়িত করে দেশটিতে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে চীন। মঙ্গলবার জিনপিং বলেন, পরিস্থিতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সে বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলজের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনায় জিনপিং বলেন, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনাকে তিন দেশের যৌথভাবে সমর্থন করা উচিত। তবে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রুশ অভিযানের নিন্দা জানায়নি চীন।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এর প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে। কাস্টেলামের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারির আগেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ২ হাজার ৭৫৪টি নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও ২ হাজার ৭৭৮টি নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এতে রাশিয়ার ওপর আরোপিত মোট নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা দাঁড়াল ৫ হাজার ৫৩২টি। এর মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা ইরানকে ছাড়িয়ে গেছে পুতিনের দেশ। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপ থাকা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা ৩ হাজার ৬১৬টি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাগুলোর ২১ শতাংশই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৮ শতাংশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জাতিসংঘ ইউক্রেনের যুদ্ধ অঞ্চলে নিরাপদে মানবিক সহায়তার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
রুশ হামলার কারণে ইউক্রেনে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সে সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, মারিয়াপোল, খারকিভ, মেলিটোপুলসহ বিভিন্ন জায়গায় বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ জরুরী সহায়তা প্রয়োজন। তিনি ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিক, বাড়িঘর ও অবকাঠামো নিরাপদ রাখতে উভয়পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। বেসামরিক নাগরিকদের রাশিয়া কিংবা বেলারুশে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব ইউক্রেন প্রত্যাখ্যান করার পর জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধ চলছে এমন এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে বেসামরিক নাগরিকদের তাদের নিরাপদে ইচ্ছেমতো গন্তব্যে যাওয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএই) বলেছে, তারা ইউক্রেনের অবরুদ্ধ দ্বিতীয় নগরী খারকিভে কামানের গোলার আঘাতে একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পেয়েছে। তবে সেখানে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। ভিয়েনা ভিত্তিক জাতিসংঘের এ সংস্থা জানায়, ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ রবিবার সেখানে হামলা চালায়। সংস্থাটি আরও জানায়, হামলার পর এ কেন্দ্রে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধি পায়নি। কারণ এ কেন্দ্রের ‘তেজস্ক্রিয় উপাদানের মাত্রা অত্যন্ত কম।
দুই সপ্তাহের যুদ্ধে ইউক্রেনের কমপক্ষে ২২শ’ সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলেছে রাশিয়া। রাশিয়ার দাবি, ইউক্রেনে স্থল, আকাশ ও নৌপথে রুশ হামলা একটি বিশেষ সামরিক অভিযান। এর লক্ষ্য দেশটিকে নাৎসিমুক্ত করা। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর জেনারেল ইগর কোনাশেনকভ বলেন, ‘ইউক্রেনে সর্বমোট ২ হাজার ২০৩টি সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। এসবের মধ্যে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ৭৬টি কমান্ড পোস্ট ও কমিউনিকেশন সেন্টার, ১১১টি এ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল সিস্টেম ও ৭১টি রাডার সিস্টেম, ৯৩টি যুদ্ধ বিমান, ৭৭৮টি ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান, ৭৭টি মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার, ২৭৯টি মর্টার, ৫৫৩টি বিশেষ সামরিক যান ও ৬২টি ড্রোন রয়েছে। এছাড়া ইউক্রেনের একাধিক সেনা ছাউনি থেকে দেশটির সৈন্যদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে। ইউক্রেনের ওপর নো ফ্লাই জোন আরোপের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, যে কোন দেশ ইউক্রেনের ওপর নো ফ্লাই জোন আরোপ করলে তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। একইসঙ্গে তিনি বৈশ্বিক অবরোধকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে বর্ণনা করেন। এর আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তার দেশের ওপর নো ফ্লাই জোন ঘোষণার অনুরোধ জানান। কিন্তু অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব বলছে, এতে যুদ্ধ আরো বিস্তৃত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। পুতিন সতর্ক করে বলেন, নো ফ্লাই জোন কেবল ইউরোপ নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই ব্যাপক ও বিপর্যকর পরিণাম ডেকে আনবে।
তৃতীয় দফার আলোচনা অগ্রগতি ছাড়াই শেষ : বেলারুশে সোমবার সন্ধ্যায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে অনুষ্ঠিত তৃতীয় দফার আলোচনা থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। আলোচনা অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। মস্কো ও কিয়েভ উভয়পক্ষের প্রতিনিধি দল এ কথা জানায়। রুশ প্রধান আলোচক ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের সহযোগী ভøাদিমির মেডেনস্কি বলেন, আলোচনায় প্রত্যাশিত ফলাফল আসেনি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের উপদেষ্টা মিখাইল পডোলিয়াকও স্বীকার করেছেন, পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর মতো কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবে উভয়পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে। শীঘ্রই চতুর্থ দফার আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানা গেছে। তবে কোন পক্ষই দিনক্ষণের কথা উল্লেখ করেনি।
ভয় পাই না : রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে দেশরক্ষার ডাক দিয়ে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। প্রথম দিকে এ গুঞ্জন উঠেছিল যে জেলেনস্কি কিয়েভ ছেড়েছেন। পরে ভিডিও বার্তা দিয়ে প্রকাশ্যে এ গুঞ্জন উড়িয়ে দেন তিনি। তবে রুশ অভিযানের পর তাকে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে দেখা যায়নি।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর প্রথমবার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে নতুন ভিডিও বার্তা দিয়েছেন জেলেনস্কি। রাশিয়ার সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নতুন ভিডিও বার্তায় বলেন, তিনি লুকাননি এবং তিনি কাউকেই ভয় পান না। সোমবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে পোস্ট হওয়া ওই ভিডিও বার্তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এসব কথা বলেছেন। জেলেনস্কি ইনস্টাগ্রামে নতুন ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমি কিয়েভের ব্যাংকোভা স্ট্রিটেই থাকছি। আমি কোথাও লুকাইনি এবং কারও ভয়ে ভীত নই।’ জেলেনস্কির অবস্থান জানিয়ে ভিডিও বার্তা দেয়ায় মনে হচ্ছে কিয়েভে ইউক্রেনের সেনাদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন রাশিয়ার সেনারা।
ইউক্রেনে হতাহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যা ১,২০৭ : জাতিসংঘের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউক্রেনে ২৪ ফেব্রুয়ারির রুশ অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১,২০৭ জন বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার লিজ থ্রোসেল বলেন, এর মধ্যে ৪০৬ জন নিহত এবং ৮০১ জন আহত হয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। বেশিরভাগ মানুষই বিমান হামলা ও বিস্ফোরক অস্ত্রে হতাহত হয়েছেন।