আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ॥ যারা ৭ মার্চ পালন করে না ধরেই নিতে হবে এরা স্বাধীনতা চায়নি

7
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রান্তে যুক্ত হয়ে ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ’ উদযাপন উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বে অর্থনীতির মন্দার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বর্তমানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে একটা কথা আসছে। এটা শুধু বাংলাদেশে না, করোনার কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা। যে কারণে পৃথিবীর সব দেশেই, সুদূর আমেরিকা থেকে শুরু করে সব দেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে এখানেও সে প্রভাবটা পড়ে, আর কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণীতো রয়েছেই এই সুযোগটা নেয়ার জন্য। তবে তার সরকার দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাজার মনিটরিং করছে।
সোমবার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দিবসটা কে পালন করল বা না করল, সেটা নিয়ে বোধ হয় আমাদের চিন্তা করার কিছু নাই। এটা ধরেই নিতে হবে এরা সেই গোষ্ঠী যারা এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি। যারা শত্রুর পক্ষে, যাদেরকে বাঙালী যুদ্ধ করে পরাজিত করেছে, এরা সেই গোষ্ঠী যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে- তারা ৭ মার্চ কখনই পালন করতে পারে না, এটা হচ্ছে বাস্তব কথা। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওই পরাজিত পাকিস্তানীদের গোলামি করা, পদলেহন, খোসামোদি-তোষামোদি করা- এটা তাদের মজ্জাগত। বংশ পরম্পরায় যেন এটা নিয়েই তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বৈশি^ক মন্দা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তার সরকার দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাজার মনিটরিং করছে। সেই সঙ্গে এখন বিশেষ করে একটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা হচ্ছে ইউক্রেন এবং রাশিয়া; রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। সেটা নিয়েও একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সারাবিশ্বে। যার কুফলটা আসছে এখন। আমরাও তার কুফল ভোগ করছি। আর আমাদের এখানে কিছু জিনিসের দাম বাড়ছে কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে এখানেও তার প্রভাবটা পড়ে। তাছাড়াও কিছু লোকতো এখানে আছেই এই সমস্ত সময়ে ব্যবসা করে তারা দু’পয়সা কামাই করতে চায়। সেখানে মনিটরিং আমরা করছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আরও বক্তব্য রাখেন দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি ও হুমায়ুন কবির। গণভবন প্রান্ত থেকে সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির কড়া সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির নেতারা একে তো দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত। তার উপর তাদের নেতৃত্ব কোথায়? ‘ফিউজিটিভ’ হয়ে বসে বসে এদেশের মানুষের জন্য ধ্বংসের কাজ করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নাই। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে আর আয়েশে বিদেশে বসে জীবন কাটাচ্ছে। আর তাজা মানুষ যারা আগুনে পুড়িয়ে মারতে পারে আন্দোলনের নামে, তাদের কাছ থেকে এদেশের মানুষ কি আশা করবে?
তিনি বলেন, ‘আমি বলব যে, কেউ ৭ মার্চের ভাষণ দিবস পালন করল বা না করল, এটা বোধ হয় আমাদের চিন্তা করার কিছু নাই। কারণ এটা ধরেই নিতে হবে, এরা সেই গোষ্ঠী, যারা এদেশের স্বাধীনতাই চায়নি। এরা সেই গোষ্ঠী যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। ২০০৪ সালে ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা করেছিল আমাকে হত্যা করতে, কিন্তু জীবন গেছে আইভী রহমানসহ কত নেতাকর্মীর।’
বিএনপির কড়া সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আরও বলেন, জীবন্ত মানুষ এরা পুড়িয়ে হত্যা করেছে। সেই পোড়া মানুষদের আমি এই সেদিনও কয়েকটা ছবি পেলাম, তার জন্য সাহায্য পাঠিয়ে দিয়েছি। এক একটা মানুষের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। তাজা মানুষ যারা আগুনে পুড়িয়ে মারতে পারে আন্দোলনের নামে, তাদের কাছ থেকে এদেশের মানুষ কি আশা করবে? আর আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। আর সেটার মাধ্যমে এখন তারাই (বিএনপি) দেশের সর্বনাশের কাজ করে যাচ্ছে, এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য।
সরকারপ্রধান বলেন, ২১ বছর ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ তারা জানে এই ভাষণের মধ্য দিয়েই জাতির পিতার আহ্বানে এ দেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। কাজেই যারা শত্রুর পক্ষে, যাদেরকে বাঙালি পরাজিত করেছে, তারা ৭ মার্চ কখনই পালন করতে পারেনা, এটা হচ্ছে বাস্তব কথা। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওই পরাজিত পকিস্তানীদের গোলামি করা, পদলেহন, খোসামোদি-তোষামোদি করা-এটা তাদের মজ্জাগত। বংশ পরম্পরায় যেন এটা নিয়েই তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নে যা করার আমরা করে দিচ্ছি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করা এটাই আমাদের লক্ষ্য। আর সেটা মাথায় রাখতে হবে। কি পেলাম না পেলাম সেটা চিন্তা করি না। আমি চিন্তা করি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কতটুকু দিতে পারলাম। যার জন্য আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবন দিয়ে গেছেন, আমার মা জীবন দিয়ে গেছেন, আমার ভাইয়েরা জীবন দিয়ে গেছে, লাখো শহীদ জীবন দিয়েছে। কাজেই তাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। স্বপ্নটা আমার না, স্বপ্নটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। এই বাংলাদেশকে তিনি কিভাবে উন্নত করতে চেয়েছিলেন, সেটাই আমরা করতে চাই।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এখনও জাতিকে অনুপ্রেরণা দেয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চের এই ভাষণ এখনও আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণের প্রতিটি লাইন অর্থবহ। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। বিশ্বে আর কোন ভাষণ এত বছর এই রকম প্রাণবন্ত থাকেনি, যা মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারে। ৫১ বছরেও এই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি। ৭ মার্চে জাতির পিতার ভাষণ সেইভাবেই মানুষকে উজ্জীবিত করছে। কাজেই দিবসটা পালন না, শুধু এটাকে অনুসরণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
‘দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ মুজিববর্ষের সেই অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আর বাঙালীকে হাত পাততে হয় না। পুরনো কাপড় এনে পড়তে হয় না- এটা হল বাস্তবতা। আমরা নিজেরাই পারি। এটাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র অর্জন। যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা জাতির জনক বলে গিয়েছিলেন অন্তত কিছুটা হলেও আমরা তা অর্জন করে আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। যে বাংলাদেশের কথা শুনলে লোকে নাক ছিটকাত। বাংলাদেশ মানে তো গরিব, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি কথা শুনতে হতো। আজকে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা পারদর্শী, যে কোন আপদ আসলে সেটা মোকাবেলা করতে পারি এবং করোনার সময় সেটা আমরা প্রমাণ করেছি।
সরকারপ্রধান বলেন, অনেক ধনী দেশও বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেয় নাই। কিন্তু আমরা বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দিচ্ছি। বিনা পয়সায় আমরা মানুষের কাছে কি প্রয়োজন সেটা মেটাতে পারছি। এখন বর্তমানে যেমন দ্রব্যমূল্য নিয়ে একটা কথা এসেছে। এটা তো শুধু বাংলাদেশ না। করোনাভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতি মন্দা। যে কারণে আজকে পৃথিবীর সব দেশে, সেই সুদূর আমেরিকা থেকে শুরু করে সব দেশেই জিনিসপত্রের দাম ভীষণভাবে বেড়ে গেছে।
দলের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কখনও যেন খাদ্যের অভাব না হয়। তাই এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। যে যা পারবেন কিছু উৎপাদন করবেন, নিজের চাহিদাটা নিজে পূরণ করতে চেষ্টা করবেন। নিজের খাদ্যটা নিজে জোগান দিতে চেষ্টা করবেন। যদি আমরা এটা করতে পারি তাহলে আমাদের কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আর যাই হোক আমাদের মাথাপিছু আয় তো বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিএনপির আমলে কতই বা ছিল? কিন্তু আজকে আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করে নিয়ে এসেছি ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলারে । সেই সঙ্গে সবাইকে বলব যে, যার যেখানে যেটুকু জমি আছে সবাই কিছু কিছু ফসল ফলান। তরি-তরকারি যা ফলান, নিজের খাবারের ব্যবস্থাটা নিজে তৈরি করেন। কোন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক, যুদ্ধাবস্থা হোক বা যে কোন ঘটনা হোক- অন্তত আমাদের দেশের মানুষের যেন খাদ্যাভাব দেখা না দেয়, সেটাই আমাদের চেষ্টা।
সরকারপ্রধান বলেন, খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরে আমরা পুষ্টির ব্যবস্থা করেছি। বিনা পয়সায় চিকিৎসা, বই বিতরণ, সব ধরনের ব্যবস্থা আমরা করে যাচ্ছি। আজকে হতদরিদ্র কর্মহীনদের ঘর দিয়ে যাচ্ছি। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করেছিলাম, জাতির পিতা গুচ্ছগ্রাম করেছিল। আজকে প্রায় ১০ লাখের মতো মানুষ হবে ইতোমধ্যেই ঘর দিতে সক্ষম হয়েছি। এই ধরনের গৃহহীন হয়ত আর এক লাখ বা দেড় লাখ বা পৌনে দুই লাখ ঘর করে দিলে একটা মানুষও গৃহহীন থাকবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এবং গৃহনির্মাণের কাজ কিন্তু চলছে এবং এটা চলতে থাকবে। বর্ষার পরে আমরা আরও ব্যাপকভাবে করতে শুরু করব। এখন মাটি কেটে জমি কিনে রেখে দিচ্ছি, একটা বর্ষা যাওয়ার পর সেখানে আবার ঘর তৈরি করা হবে। বাকি আরও ৫০ হাজার ঘর তৈরি হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এদেশের কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না, অশিক্ষিত থাকবে না, রোগে কষ্ট পাবে না, মানুষের যে মৌলিক চাহিদাগুলো সেটা আমরা পূরণ করব এবং সফলভাবে করে যাচ্ছি।
তার সরকারের ক্ষমতার ১৩ বছরে দেশকে বদলে যাওয়ার ইতিহাস দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানেই আমাদের সাফল্য। মাত্র ১৩ বছর, এই ১৩ বছরের মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন আমরা সমাজে আনতে পেরেছি। এই ১৩ বছরের মধ্যে এখন আর পুরনো কাপড় বিদেশ থেকে এনে পরাতে হয় না। এখন আমাদের দেশের মানুষ নিজেরাই সেটা তৈরি করতে পারে এবং পরতেও পারে। অন্তত মানুষের এই জীবন মানটা আমরা উন্নত করতে পেরেছি মাত্র এই ১৩ বছরে। ’৭৫ পরবর্তী ২১ বছর এবং বাকি ৮ বছর এই ২৯ বছরে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দেশকে কি দিয়েছে? এদেশের মানুষকে তারা কিছু দেয়নি, শুধু শোষণ করেছে।