বিএনপির প্রতিক্রিয়া ॥ ‘ফাঁপা’ বাজেট পণ্যমূল্য বাড়াবে ৩৮.৫%

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ভোক্তার ওপর চাপ বাড়াবে বলে দাবি করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার এই বাজেট জিনিসপত্রের দাম সাড়ে ৩৮ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। এই বাজেটকে ফাঁপা বলেও মনে করে দলটি।
বাজেট পেশের পরদিন শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বিএনপি নেতা। তার দাবি, ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়ায় করের ওপর আবার কর আরোপ হবে। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম সাড়ে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে যার চাপ পড়বে সম্পূর্ণ ভোক্তার ওপর।
ফখরুল বলেন, ‘আগামী ১ জুলাই থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক আইন ২০১২ কার্যকর করা হবে। নতুন আইনে ভ্যাটের স্তর থাকবে পাঁচটি। এই স্তরভিত্তিক ভ্যাট হার অনেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যবসায়ীরা রেয়াত নিতে না পারলে এটি আবগারি শুল্কের মতো হয়ে যেতে পারে। রেয়াতের টাকা কীভাবে দেয়া হবে সেই বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আইনে ব্যবসায়ীরা রেয়াত চাইতে শুরু করলে সরকারকে নিজের পকেটের টাকা দিতে হবে। এ জন্য বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে যেতে পারে। এ ভাবে নতুন আইনটি কার্যকর হতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।’
বাজেট বড় করার সমালোচনাও করেন ফখরুল। বলেন, ‘বাজেটের আকার বড় করার চমক সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাজেট বৃদ্ধির এ প্রগলভতা বছর শেষে চুপসে যেতে দেখা যায়। বাজেটের আকার কত বড়-এ নিয়ে আর জনমনে কোন উচ্ছ্বাস নেই। কেননা প্রত্যেক বছর বছরের শেষ দিকে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ যেভাবে কাট-ছাঁট করা হয়তাতে বিরাট আকার বাজেটের অন্তঃসার শূন্যতাই প্রকাশ পায়।’
প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এটি ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বেশি। এত টাকা আদায় করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন ফখরুল। বলেন, ‘বর্তমানে যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে তাতে ঘাটতি বরং আরও বাড়বে।’
বিএনপি নেতা বলেন, ঘোষিত বাজেটের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ- সময় এখন আমাদের সময় এখন বাংলাদেশের’। কিন্তু এই তথাকথিত উন্নয়নের ‘গীত’ আর মানুষ শুনতে চায় না। কর আর দ্রব্যমূল্যের চাপে ভোক্তা সাধারণের এমনিতেই নাভিশ্বাস উঠেছে। আয়-বৈষম্য, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের কারণে সামাজিক অস্থিরতার মুখোমুখি জনগণ এখন আর উন্নয়নের মিষ্টি কথায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না।
অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য রাজস্ব ব্যয়ের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ারও সমালোচনা করেছে বিএনপি। ফখরুলের দাবি, এই বরাদ্দ মাত্রাতিরিক্ত।
মেগা প্রকল্পে ‘অস্বাভাবিক খরচ’ নিয়েও প্রশ্ন রাখেন বিএনপি নেতা। বলেন, ‘চার লেন সড়ক তৈরিতে যেখানে ভারতে ১১ থেকে ১৩ লাখ ও চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে ৫০ লাখের বেশি।’
‘সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে বালিশ দুর্নীতির যে খবর জনসম্মুখে এসেছে তাকে হিমবাহের চূড়া বলা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রকল্পে কোন পর্যায়ের দুর্নীতি হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়।’
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ কেন সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সলিল সমাধি হচ্ছে-সেই প্রশ্নও তুলেন বিএনপি নেতা। তার দাবি, শিক্ষা খাত প্রায় ধ¦ংস হয়ে গেছে। সংখ্যায় বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মানে ধ্বস নেমেছে। শিক্ষা খাতে ব্যয় মোট জিডিপির ৩.২ শতাংশেরও কম। স্বাস্থ্য খাতে ১ শতাংশেরও কম।
সরকার প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর আদায় করছে বেশি-এমন উল্লেখ করে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘পরোক্ষ করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে বেশি। এদিকে সাধারণ মানুষের অর্থে যে বাজেট তৈরি হয় তার ব্যয় থেকে ধনীদের ভর্তুকি দেয়া হয়।’
প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ লাখ লোককে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার আওতায় এনে যে সাহায্য দেয়া হয় সেটা সমুদ্রে ‘এক বিন্দু শিশিরের মতো’ বলেও মনে করেন ফখরুল।
দেশ থেকে বছরে ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘কানাডায় কারা কোন মার্কেটের মালিক, নিউ ইয়র্কে এবং লন্ডনে কাদের কী আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সৌজন্যে সকলেরই জানা।’
খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ফখরুল। তার দাবি, আমদানি যে হারে বাড়ছে সে হারে রপ্তানি বাড়েনি। এই কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। ব্যাংক খাতের তীব্র এই সংকটের সময়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
বাজেটে মৌলিক সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না দাবি করে বিএনপি নেতা বলেন, ‘নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর জন্য চাকরির বাজার অপর্যাপ্ত। আবার চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষার মান সমানতালে বেড়ে উঠছে না।’
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি বলেও মনে করেন ফখরুল। বলেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসা, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ না বাড়া, ফি বছর বেকারত্বের হার বৃদ্ধির কারণেও উন্নয়ন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না।
বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ফখরুল। বলেন, ‘আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ অত্যধিক।’
সরকার অনির্বাচিত দাবি করে এিনপি নেতা বলেন, ‘সরকারের বাজেট দেয়ার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।…গণতন্ত্র না থাকায় সুশাসন নেই দেশে। সু-শাসনের অভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত। …সরকার দেশকে ঋণনির্ভর অর্থনীতির বৃত্তে আবদ্ধ করে রেখেছে। এই ঋণ শোধ দিতে দেশের মানুষের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। নাগরিকদের ভুগতে হবে চরমভাবে।’