কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বীমা খাতকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল ও অটোমেশনে আনার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, এটা যদি ডিজিটাল হয়, প্রিমিয়াম দেয়ার ব্যাপারে বা কোন ব্যাপারে সরাসরি যদি কাজ করা যায়, অনলাইনে করা যায়, তাহলে সকলের জন্য সুবিধা হবে, সবাই আগ্রহী হবে। সবার সুবিধার পাশাপাশি সকলে বীমা করায় আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে। এখন তো আমাদের দেশটা আমরা ডিজিটাল করে ফেলেছি। সবকিছু এখন ডিজিটালি হয়। কাজেই আমি মনে করি যে বীমা খাতটা সম্পূর্ণভাবে ডিজিটালাইজড এবং অটোমেশনে আনতে হবে।
মঙ্গলবার ‘জাতীয় বীমা দিবস-২০২২’ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
মানুষ যাতে বীমা করতে আগ্রহী হয় সেজন্য বীমা খাতের সেবায় প্রযুক্তিকে যুক্ত করে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার চালানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এখন কেনা-বেচাসহ সবকিছুই ডিজিটালি হয়। আর ডিজিটাল করেছিলাম বলেই করোনাকালীন সময়ে আমাদের অর্থনীতির চাকা যেমন সচল রাখতে পেরেছি, মানুষের জীবন জীবিকাও সচল থেকেছে।
গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে ইউনিফাইড ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি) চালু করা হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বীমা নিয়ে মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে। গ্রাহকের স্বার্থকে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেবা দিতে হবে। মানুষকে বীমা বিষয়ে আগ্রহী করতে নতুন নতুন পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। জনগণকে আরও উৎসাহিত করতে হবে। এটাই আমার একটা অনুরোধ থাকবে। তিনি বলেন, বীমা সেবা যদি মানুষ হাতের কাছে পায়, তাহলে অনেকে তার জীবন নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে। সেজন্য সরকারী-বেসরকারী বীমা কোম্পানিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম. মোশাররফ হোসেন এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বীমা খাতে অসামান্য অবদানের জন্য পাঁচজনকে ‘বীমা পদক’ এবং দুইজন প্রতিবন্ধী শিশুকে ‘বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা পলিসি’ প্রদান করেন।
অনুষ্ঠানে বীমা খাতের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। ১৯৬০ সালের ১ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। তাই সরকার প্রতিবছর ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বীমা সেবাটা যদি মানুষ হাতের কাছে পায় তাহলে অনেকেই কিন্তু তার জীবনটা নিশ্চিন্ত হতে পারে। সেজন্য সরকারী বেসরকারী বীমা কোম্পানিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্তত আমি এইটুকু বলতে পারি আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর আমরা কিন্তু বেসরকারীখাতে অনেক বীমা কোম্পানি দিয়েছি। তাতে যেমন অনেকের ব্যবসা করারও সুযোগ হয়েছে। বীমা ব্যবসায় যেমন সবাই সম্পৃক্ত হয়েছে পাশপাশি আমাদের দেশের অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, তিনি যে কাজটাই করেন সবসময় মাথায় থাকে জনগণের কর্মসংস্থানের বিষয়টি। এজন্যই তিনি প্রথমবার ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পর বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করেছেন। এই উন্মুক্ত করে দেয়ার একটাই উদ্দেশ্য সেটা হলো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং সেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, বেকারত্ব দূর হচ্ছে।
বীমাকে ‘জনগণের আমানত’ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বীমা ব্যবসায়ীদের বীমা দাবি ও অন্যান্য সুবিধা যথাসময়ে কোন ঝামেলা বা হয়রানি ছাড়া গ্রাহকদের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো বীমা ব্যবস্থা আমাদের দেশেও চালু হোক-সেটাই আমরা চাই। একটি সিস্টেম তৈরি করতে হবে যাতে ক্লায়েন্টরা তাদের বীমা দাবি সঠিক সময়ে কোন ঝামেলা ছাড়াই পেতে পারে। এই বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
অতীতে পাটের গুদামে পুনঃপুনঃ অগ্নিকা-ের ঘটনার উল্লেখ করে বীমার মিথ্যা দাবির বিষয়ে বীমা কোম্পানিগুলোকে আরও সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ধরনের ঘটনা তৈরি পোশাক খাতেও ঘটেছে বলে তার কাছে অভিযোগ থাকার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যেত ঘন ঘন শুধু আগুন লাগে, আমার সন্দেহ হলো এবং নজরদারি শুরু করলাম। বাস্তবে দেখা গেল ঘটনা তাই।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় গাড়ির থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সকে প্রতারণামূলক কাজ হিসেবে উল্লেখ করে এটি বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সকে বন্ধ করতে বলেছি। এখন এটি বন্ধ করতে হবে কারণ এটি ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ তিনি এ বিষয়ে সতর্ক এবং গাড়ির ইন্স্যুরেন্স সবসময় করে রাখেন উল্লেখ করে বলেন, সততার সঙ্গে কাজ করলে সবাই লাভবান হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, যিনি এটা করছেন তিনি ভাবলেন টাকা বাঁচালাম কিন্তু যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন যে মোটা অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে সেটা আর মাথায় থাকে না। কিন্তু বীমা করা থাকলে গাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেকোন ক্ষেত্রেই আপনি সহযোগিতাটা পেতে পারেন। এক্ষেত্রে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও ইন্স্যুরেন্স জরুরী বলে তিনি উল্লেখ করেন।
‘জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বীমা খাতের বিকাশে তার সরকারের যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর বীমা ঝুঁকি সাধারণ বীমা কর্পোরেশন গ্রহণ করেছে। বিদেশগামী বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য প্রবাসী কর্মী বীমা, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি মোকাবেলায় হাওড় এলাকায় সীমিত পরিসরে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমা চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা/অভিভাবকের অকাল মৃত্যুতে/শারীরিক অক্ষমতায় তাদের শিক্ষাজীবন যাতে ব্যাহত না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা’ প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বীমা শিল্পকে জাতীয়করণ করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তার উদ্যোগে লাইফ বীমা সেবা প্রদানের জন্য ‘জীবন বীমা কর্পোরেশন’ এবং নন-লাইফ বীমা সেবা প্রদানের জন্য ‘সাধারণ বীমা কর্পোরেশন’ নামে দুটি পৃথক বীমা কর্পোরেশন গঠন, বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহকে তত্ত্বাবধান করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বীমা অধিদফতর গঠন এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি প্রতিষ্ঠাসহ বীমা শিল্পের বিকাশে জাতির পিতার বিভিন্ন যুগোপযোগী পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
বীমা খাতে তার সরকারের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বৃত্তি প্রদানের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বৃত্তি প্রাপ্তদের বিদেশে থেকে না গিয়ে ফিরে এসে তারা যেন দেশের জন্য কাজ করেন সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখার জন্যও সংশ্লিষ্টমহলকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যাদের বৃত্তি দেয়া হচ্ছে তারা যেন ঠিকমতো শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসে। কারণ দেশের জন্য তো কাজ করতে হবে। সবার ভেতরে দেশের প্রতি এই দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। বিষয়টা আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়কেও যেমন দেখতে হবে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই চেতনাটা জাগ্রত করতে হবে, সেটা আপনারা দেখবেন।
তার সরকারের সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছোট্ট ভূখ-ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষকে একটা সুরক্ষিত জীবন দিতে হবে। যাতে কোন মানুষ হতদরিদ্র না থাকে, প্রত্যেকেই একটা সুন্দর জীবন পায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তার সরকার প্রতিটি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যার সুফলও মানুষ পাচ্ছে। তার সরকার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জনজীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ন করছে। এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আমাদের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিও আরও বেশি সচল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বীমা কোম্পানির সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, মানুষ যাতে তাদের কাছে আমানতটা রেখে নিজের এবং পরিবার-পরিজনের ভবিষ্যত জীবনকে সুরক্ষিত করতে পারে, সেটার ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে আরও কাছে এগিয়ে আনতে হবে।