কাজিরবাজার ডেস্ক :
উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়ে গেছে। বেশ কয়েক বিচারপতি ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলায় রায়ের আদেশ প্রদান করেছেন। আবার এমন বিচারপতিও রয়েছেন যিনি শুরু থেকেই আজও মোশন, আদেশ ও রায় প্রদান করছেন। হাইকোর্টের পাশাপাশি আপীল বিভাগ থেকেও বাংলাতে রায় এসেছে। এদিকে ১৮৮৬ সালে দেওয়ানি আদালত সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত নিম্ন আদালতে বাংলাতেই বিচার কাজ চলছে। ‘আমার ভাষা’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংবলিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বাংলায় রায় অনুবাদ করা হচ্ছে। এতে করে বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ জনগণ উপকৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আইনজীবীগণ জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাড়ছে, এটা একটা শুভ লক্ষণ। বেশিরভাগ রায় ও আদেশ বাংলায় না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লোকবলের অভাব, টাইপের অসুবিধা, বহুল প্রচলিত ফ্রন্টে কম্পোজ না করা, যে কারণে সহজেই ফন্ট পরিবর্তন করা যায় না। টাইপিং ডিভাইস সফটওয়্যার চেঞ্জ না করা, বাংলায় রায় লেখার মানসিকতার অভাব, বাংলা লেখাটা কঠিন, বিও বাংলায় ডিকটেশন দ্রুত না লিখতে পারা এবং আইনজীবীদের শুনানি ও বিভিন্ন আবেদন বাংলায় না লেখাই এর অন্যতম কারণ। ’১৫ সাল পর্যন্ত কজলিস্টগুলো বাংলাতেই হতো। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ’১৫ সালের পর ইংরেজীতে এটা চালু করেন। ইংরেজীতে রায় লেখা বা আবেদন করা বাধ্যতামূলক নয়। ইচ্ছা করলে বাংলায়ও রায় লেখা যাবে। কোন কোন বিচারপতি বাংলায় রায় লিখছেন। তবে সংখ্যায় খুবই কম। এই সংখ্যা আর বেশি হলে বিচারপ্রার্থীগণ উপকৃত হবে।
ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন ,আমার মতে উচ্চ আদালতে বাংলার চর্চাটা অত্যন্ত জরুরী। অনেক কোর্টে বাংলায় পিটিশন দেয়া হচ্ছে। সবাই যদি ধীরে ধীরে একটা/দুটা রায় বাংলায় প্রদান করেন তা হলে সবাই উপকৃত হবে। অন্তত বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানো উচিত। দিন দিন বাংলা ভাষার কদর আদালতে বাড়ছে। অনেক বিচারপতি আছেন যারা নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আইনজীবী ও বিচারপতিদের মধ্যে সহযোগিতা থাকতে হবে।
এতদসত্ত্বেও উচ্চ আদালতে বাংলায় আদেশ ও রায় প্রদান করা হচ্ছে। আপীল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম হাইকোর্টে থাকা অবস্থায় ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাতে রায় প্রদান করেছেন। ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে বাংলায় রায় প্রদান করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। তিনি হাইকোর্টে থাকা অবস্থায় কয়েক হাজার আদেশ ও রায় বাংলাতে প্রদান করেছেন। এ ছাড়া বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ আহসান উল্লা হত্যা মামলার রায় বাংলাতে প্রদান করেছেন। বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠার রায়য বাংলায় প্রদান করেছেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ২০১৬ সালের ৫ মে তিন বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল বাংলায় রায় লেখেন। তিনি বেশ কিছু রায় ও আদেশ বাংলায় প্রদান করেছেন। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হত্যা চেষ্টার মামলায় বাংলাতে রায় প্রদান করেছেন। অন্যদিকে বিচারপতি জাকির হোসেন বিচারপতি হিসেব্ে নিয়োগ পাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি বাংলাতেই আদেশ ও রায় প্রদান করে যাচ্ছেন। ২০১০ সালে তিনি হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় , দায়রা আদালতের রায়ের পর্যালোচনায় যখন হাইকোর্ট মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত করেন, তখন ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান পক্ষ, আসামি বা বাদী যে-ই হোন, তিনি ইংরেজী ভাষার কারণে প্রকাশিত রায় বুঝতে পারেন না, জানতে পারেন না- কী কারণে এবং কিসের ভিত্তিতে তার দ-াদেশ বহাল থাকল বা খালাস হলো। সে কারণে এগুলো বাংলাতেই দেয়া প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় , বেশ কয়েক বিচারপতি বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। ভাষার মাস আসতে অনেকেই বাংলায় রায় লেখার চেষ্টা করেন। এর আগে প্রয়াত বিচারপতি এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আব্দল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ কিছু বিচারপতি বাংলা ভাষায় বেশ কিছু রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ১৯৮৯ সালের দিকে উচ্চ আদালতে সর্বপ্রথম বাংলায় রায় দেন বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী। সাবেক প্রধান বিচারপতি (বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান) এ বি এম খায়রুল হকও বাংলায় রায় দেন। তিনি ২০০৭ সাল থেকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় দুই শ’ রায় বাংলা ভাষায় দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আইন কমিশনও এর আগে বাংলায় রায় দেয়ার জন্য একটি সুপারিশ প্রদান করে। দীর্ঘদিন পরও ওই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে, অথচ মহান ভাষা এই দেশেরই উচ্চ আদালতে উপেক্ষিত। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদটি জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ দিয়েছে।