কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশব্যাপী বইছে হিমেল হাওয়া। কমছে তাপমাত্রা। এর প্রভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই শীত বেড়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় শীতের তীব্রতা বেশি। এ কারণে জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। বেড়েছে কোল্ড শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগ। শিশু আর বৃদ্ধরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, ধারাবাহিকভাবে আরও ক’দিন শীত বাড়বে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তীব্র শীত অব্যাহত থাকবে। সেই সঙ্গে জনদুর্ভোগও বাড়বে।
আবহাওয়া অধিদফতরে কর্মরত আবহাওয়াবিদ আবদুল হামিদ জানান, বেশ ক’দিন দেশের আকাশে মেঘ ছিল। এ কারণে বৃষ্টিও হয়েছে। আকাশের সে মেঘ এখন কেটে গেছে। উপ-মহাদেশের উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ এখন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান করছে। এ কারণে তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি বইছে হিমেল হাওয়া। তাই সারাদেশেই শীত বেড়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের কোন কোন জেলায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। আরও ক’দিন আকাশ মেঘমুক্ত থাকবে এবং তাপমাত্রা আরও কমবে। এ কারণে শীতের তীব্রতা আরও ক’দিন থাকবে। এর পর আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়বে এবং হিমেল হাওয়ার দাপট কমে শীতের তীব্রতা কমতে শুরু করবে।
‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’ এ প্রবাদটির দেশের অধিকাংশ মানুষ জানলেও বিগত ক’বছর ধরে তুলনামূলক শীত কম থাকায় এ প্রভাতের কথা কেউ কেউ ভুলতে বসেছিল। এবার মাঘের শুরুতে বৃষ্টির কারণে শীত কিছুটা কমই ছিল। তবে বৃষ্টির পর আকাশের মেঘ কেটে যাওয়ায় মাঘ মাসের মধ্যভাগে এসে সারাদেশেই শীত জেঁকে বসে। সেই সঙ্গে শুরু হয় অতিসাধারণ ও হতদরিদ্র মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেকেরই ভাঙ্গা ঘরের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে হিমেল হাওয়া। তাই শীত নিবারণের জন্য পর্যাপ্ত গরম কাপড় না থাকায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। শ্বাসকষ্ট ও কোল্ড ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগে কাতর হয় তারা। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা শীতের তীব্রতা সহ্য করতে পারে না বলে রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। আর রোগীদের অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
এদিকে কনকনে শীত এবং অপরদিকে কুয়াশার কারণে জেঁকে বসা হিমেল হাওয়ায় সারাদেশেই এখন জবুথবু জনজীবন। এরপরও বসে নেই শ্রমজীবী মানুষ। জীবিকার তাগিদে তীব্র শীত উপেক্ষা করে নিজ নিজ কর্মে নেমে পড়ছেন। প্রয়োজনের তুলনায় গরম কাপড় কম থাকায় শীতের মধ্যেই কাঁপতে কাঁপতে ঘরে থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছেন তারা। আর ছিন্নমূল মানুষদের তো দুর্ভোগের কোন সীমাই নেই। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন তারা।
তীব্র শীতের কারণে সবচেয়ে বেশি কষ্ট শিকার করছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, তেঁতুলিয়া, রংপুর, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন জেলায় শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষরা পড়েছেন চরম বিপদে। হিমেল হাওয়া, শীত ও কুয়াশার কারণে শ্রমজীবী মানুষেরা কাজে যেতে পারছেন না। যারা ঘর থেকে বের হচ্ছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এছাড়া মেঘলা আকাশ ও বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরতে থাকায় রাস্তায় যানবাহন চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেকে রিক্সা ও ভ্যানসহ ছোট ছোট যানবাহন চলানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে পরিবহন সঙ্কট। শীতের তীব্রতায় বয়স্ক মানুষগুলো ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। দিনভর ঘরের মধ্যে গায়ে কাঁথা-কম্বল জড়িয়ে শুয়ে-বসে অলস সময় পার করছেন। বোরো মৌসুমে চারা রোপণের কাজও ব্যাহত হচ্ছে। শীতজনিত এ পরিস্থিতি দেশের বিভিন্ন এলাকার নদ-নদী সংলগ্ন বাঁধে আশ্রয় নেয়া মানুষজনের দুঃখ-কষ্ট বেড়ে গেছে। ঠান্ডার কারণে মাঠে যেতে না পারায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
এদিকে আবহাওয়া অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোঃ বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত পূর্বাভাস বার্তায় জানানো হয়, শুক্রবার সকাল থেকেই সারাদেশে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ওপর দিয়ে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তা আরও বাড়তে পারে। চলমান শৈত্যপ্রবাহের কারণে সারাদেশে তাপমাত্রা আরও ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস কমতে পারে। এর ফলে কোন কোন এলাকায় শীতের তীব্রতা আরও বাড়বে। এর ফলে বিপর্যস্ত হয়ে উঠবে জনজীবন।
শুক্রবার আবহাওয়া অধিদফতর থেকে ৭২ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মোঃ বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত বার্তায় জানানো হয়, অস্থায়ীভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেঘলা আকাশ থাকতে পারে। তবে সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। এছাড়া মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের নদী উপকূল এলাকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় হাল্কা থেকে মাঝারি কুয়াশা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন-রাতের তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। এর ফলে শীত বাড়বে। তবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ শেষে আবার শীত কমতে পারে।
আবহাওয়া অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শুক্রবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাটে ৬.১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা আগের দিনের চেয়ে কয়েক ডিগ্রী সেলসিয়াস কম। এছাড়া সব বিভাগেই তাপমাত্রা আগের চেয়ে কমেছে। শুক্রবার ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এ ছাড়া অন্যান্য বিভাগীয় সদরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল রংপুরে ৮ দশমিক ২ ডিগ্রী, সিলেটে ১৪ দশমিক ২ ডিগ্রী, চট্টগ্রামে ১৫ দশমিক ৭ ডিগ্রী, ময়মনসিংহে ১০ ডিগ্রী, রাজশাহীতে ১২ দশমিক ৮, খুলনায় ১২ ডিগ্রী, বরিশালে ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, অন্যান্য বছর ডিসেম্বরের শুরু থেকে মধ্য জানুয়ারির মধ্যে শীতের তীব্রতা বাড়লেও এ বছর শীত বেড়েছে জানুয়ারির একেবারে শেষ প্রান্তে এসে। আবহাওয়ার বৈরী প্রভাবের কারণে শেষ সময়ে এসে এবার শীত বেড়েছে বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন। আর মৌসুমের শেষ দিকে শীত বাড়ায় অনেকেই তা মোকাবেলায় ছিল অপ্রস্তুত। আর এ কারণেই দুর্ভোগ কিছুটা বেড়েছে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার রিক্সাচালক সোলায়মান জানান, হঠাৎ শীত বেড়ে যাওয়ায় আয়-রোজগার কমে গেছে। যাত্রীও কম। ঠান্ডার কারণে রিক্সা চালাতেও কষ্ট হচ্ছে। তাই একটু পর পর বিশ্রাম নিতে হচ্ছে।
উত্তরা থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকারী রাইদা বাসের সুপারভাইজর সালাউদ্দিন জানান, ঠান্ডা বাতাস, কুয়াশা ও তীব্র শীতের কারণে এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বাসে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। জরুরী কাজ ছাড়া অনেকেই বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। তবে রিজিকের তাগিদে শীত উপেক্ষা করেই আমাদের কাজে নামতে হয়েছে।
মগবাজারের শীতের পিঠা বিক্রেতা আমেনা বেগম জানান, কনকনে শীত ও ঠান্ডা বাতাসের কারণে পিঠা খাওয়ার কাস্টমার কমে গেছে। তাই পিঠা বিক্রিও কমে গেছে। এছাড়া চুলার আগুন নেভালেই বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। তাই শীত কবে কমে আসবে সে জন্য অপেক্ষা করছি।