ভোটের নীরব প্রস্তুতি শুরু

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের প্রায় তিন বছর পার হতে চলেছে। সেই হিসাবে আগামী সংসদ নির্বাচনের দুই বছরের বেশি সময় বাকি থাকলেও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভোটের নীরব প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ায় স্থবির জীবনযাত্রায় যেভাবে গতি ফিরেছে, ঠিক সেইভাবেই রাজনৈতিক দলগুলোও চাঙ্গা হচ্ছে। সরকারী ও বিরোধী সব দলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনকে টেস্ট কেস হিসেবে ধরে দলগুলোর প্রস্তুতি এগোলেও সবার মূল লক্ষ্য আগামী সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে বড় দলগুলো মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি চাঙ্গা করতে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে নতুন কমিটি গঠন করছে।
করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সারাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন একরকম ঝিমিয়ে পড়েছিল। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় নির্বাচনী ডামাডোলও বাজতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিল অনুসারে আগামী ১১ নভেম্বর দেশে দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের উপ-নির্বাচন ও ১০ পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২ নবেম্বর। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে সারাদেশে দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম বিস্তৃত করার প্রস্তুতি চলছে। উল্লেখযোগ্য দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, করোনার মধ্যেও মূলত ইউপি নির্বাচন ঘিরেই সারাদেশে রাজনীতি আবার সরগরম হয়ে উঠবে।
আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্য কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন, প্রার্থী বাছাই এবং বিদ্রোহী প্রার্থী যাতে না থাকে, সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। একই সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনের মাঠে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। এছাড়া স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে দেশব্যাপী দলের অপূর্ণাঙ্গ কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করার উদ্যোগ। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি আগের মতো ভবিষ্যতেও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি-জেপি, জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ (আইএবি) অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দলও বিশেষত ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে সংগঠন গোছানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি দলীয় ফোরামের একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও সৎ, যোগ্য ও স্বচ্ছ ইমেজের এবং বিতর্কমুক্ত নেতাদেরই প্রার্থী করা হবে। কিন্তু নির্বাচন ঘিরে কোথাও কোন ধরনের বিদ্রোহ কিংবা বিশৃঙ্খলা বরদাশত করা হবে না। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কঠোর সাংগঠনিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ধারণা, ইউপির আগে পৌরসভা এবং সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন ঘিরে দলগুলোর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতাও ধাপে ধাপে মাঠে বিস্তৃত হবে। আর সাংগঠনিক তৎপরতা দেশব্যাপী পূর্ণতা পাবে কার্যত ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে।
স্থানীয় নির্বাচন ঘিরে সরকারী দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিও পর্যায়ক্রমে দল গোছানোর কাজে হাত দিয়েছে। গত একমাসে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব দলের বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। মতবিনিময়কালে দলকে শক্তিশালী করা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ইসি গঠন, নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর মতো সুপারিশ উঠে এসেছে। দলকে শক্তিশালী করতে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগও নিয়েছে দলটি। নিজ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দলটির শীর্ষ নেতারা পেশাজীবীদের সঙ্গেও বৈঠক করছেন।
আওয়ামী লীগের জোটের শরিক জাতীয় পার্টিতে বিভক্তি থাকলেও তারা আগামী নির্বাচন ঘিরে নতুন হিসাব-নিকাশ কষছে। জোটের ছোট ছোট দলও আস্তে আস্তে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে জাতীয় সংসদ ও সংসদের বাইরে।
বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো ইউনিয়ন, পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সবার চোখ আগামী সংসদ নির্বাচনের দিকে। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুটা কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেছে। সময়ের অভাবে আইন করে ইসি নিয়োগের সুযোগ না থাকায় বিগত দুবারের মতো এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠন করা হবে বলে সরকারী দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও তার জোটের সহযোগী দলগুলো মনে করছে, সার্চ কমিটির মাধ্যমে সরকার পছন্দের মানুষকে ফের নিয়োগ দিতে চাচ্ছে। দলটি বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোন নির্বাচনেই অংশ নেবে না।
এদিকে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে যারা জোটবদ্ধ হয়ে আছেন তারাও এখন নড়েচড়ে বসছেন। হিসাব কষছেন আগামী নির্বাচনে বৈতরণী পার হওয়ার কলাকৌশল নিয়ে। জোটে থেকে রাজনৈতিক প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়েও হিসাব করছেন তারা। এরই মধ্যে জোট নিয়ে দুই বড় দলের নির্বাচিত নেতারা কাজ শুরু করেছেন। নীরব দায়িত্ব পেয়ে ওই সব নেতা আপাতত ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের ছক কষছেন তারা। শীঘ্রই এসব বিষয় সামনে চলে আসবে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা। তারা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে নানামুখী চমকের মধ্য দিয়ে।
আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক জোটগুলোতে কিছুটা রদবদল আসতে পারে। বিশেষ করে ইসিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন স্থগিত হওয়ার পর বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আগামী নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। তাই এক্ষেত্রে চমক থাকতেই পারে। অর্থাৎ একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও নির্বাচন হতে পারে। সামনে এ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা আসতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
অতি সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ৯ নেতা গ্রেফতারের পর রাজনৈতিক গুঞ্জন শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজপথে না থাকলেও মাঠ দখলের রাজনীতিতে এই জোটে জামায়াতের গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের পর জোটের প্রধান দল বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াত নেতাদের পক্ষ নিয়ে সরাসরি কোন বিবৃতি আসেনি। কিন্তু রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে বিএনপিকে পাশে চেয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। অনেকেই মনে করেন সাম্প্রতিক কিছু ইস্যুতে দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ঠিক কাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে সেটি এখন স্পষ্ট নয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ককে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই খোলাসা হয়ে যাবে।
অপরদিকে জোটের রূপরেখা নিয়ে অনেকটা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকারী দল আওয়ামী লীগ। আপাতত আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ইসি গঠনের ওপর জোর দিচ্ছে দলটি। কারণ সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণেই ফেব্রুয়ারিতেই ইসি গঠন করতে হবে। আর সেটি করতে হবে সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই। তাই ইসি গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দলকে প্রস্তত করা হবে। সেটির টেস্ট কেস হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনগুলোকে বেছে নেয়া হবে।
সরকারী দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক পট খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। নির্বাচনের দেড় বছরেরও বেশি সময় বাকি রয়েছে। তাই জোট নিয়ে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের সময় এখনও আসেনি। বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, রাজনৈতিকভাবে দুটি দল এখনও একাট্টা। বিএনপি যদি জামায়াতকে তাদের জোট থেকে সরিয়ে দেয় তাহলে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে। আগে বিএনপি-জামায়াত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিক তারপর আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবে। ২০ দলীয় জোটের শরিকদের অনেকে এরই মধ্যে বিএনপিকে জামায়াত থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছে। সেটি সময় গেলেই স্পষ্ট হবে বলেও আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধারক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় পরবর্তীতে জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ ও মেরুকরণ তৈরি করেছিল। ২০১২ সালে বিএনপি চারদলীয় জোট বিলুপ্ত করে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে। ১৮ দলীয় জোট পরবর্তীতে ২০ দলীয় জোটে পরিবর্তিত হয়। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ফলে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীগণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩টি আসনে জিতে যান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দশম জাতীয় সংসদ ছিল ২০ দলীয় জোটশূন্য।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় জতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী শুরুতে ঐক্যফ্রন্টে থাকেন। পরে মতের মিল না হওয়ায় ফ্রন্ট ছেড়ে আওয়ামী জোটে শরিক হন। ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলো হলো গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট লাভ করে সাতটি আসন। তবে সংসদে বিরোধীদলীয় দল হিসেবে জাতীয় পার্টি দায়িত্ব পালন করছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার পর দলের দায়িত্ব পান তার ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তাই নতুন নেতৃত্ব আগামীতে জাতীয় পার্টিকে কোন জোটে নিয়ে যাবে সেটি নিয়েও রয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
তবে বিএনপির নির্ভরশীল একটি সূত্র দাবি করেছেন, সংসদ নির্বাচনের দুই বছর বাকি থাকলেও এবার বিএনপি আগে থেকেই নির্বাচন নিয়ে কঠোর অবস্থান থাকবে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়াই দলটির একমাত্র লক্ষ্য। সেইসঙ্গে ইসির পুনর্গঠনেও দলটি কড়া নজর রাখছে।