ইসি গঠনে সার্চ কমিটি ॥ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি ॥ জানুয়ারির মধ্যেই হবে এই কমিটি

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই, এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই গঠন করা হবে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সার্চ কমিটির পক্ষে তাদের অবস্থান জানান দিলেও বিএনপি এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবে। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের পর ওই কমিটির সুপারিশ করা নামের তালিকা থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ৪ জনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তবে সার্চ কমিটি গঠনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনাও করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। সূত্র জানায়, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের মধ্যেই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। সার্চ কমিটি গঠনের পর ওই কমিটির সদস্যরা বসে অভিজ্ঞ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্যদের নিয়ে একটি তালিকা করে রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করবেন। আর এই তালিকা থেকেই রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে ইতোমধ্যেই তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। তারা মনে করছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সার্চ কমিটির মতো স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন ছাড়া তেমন কোন বিকল্প নেই। এ ছাড়া এর আগে ২ বার সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে তেমন কোন সমালোচনা হয়নি। আর মাত্র ৫ মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য নতুন একটি আইন প্রণয়ন করাও প্রায় অসম্ভব।
এদিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি চিঠি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। বিএনপিকে অনুসরণ করে সমমনা আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেবে বলে জানা গেছে। চিঠিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোকদের নিয়ে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হবে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে ফাইল ওয়ার্ক শুরু করেছেন দলের কিছু সিনিয়র নেতা।
২০১৭ সালে ৫ বছরের জন্য গঠন করা হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে এ কমিশনের মেয়াদ। ইতোমধ্যেই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সরকারী দল আওয়ামী লীগও এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারেই নিচ্ছে। তবে আগে সরকারী দলের কেউ কেউ নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করলেও এখন এ ইস্যুতে নীরব রয়েছেন। আর বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ কেউ আইন প্রণয়নের কথা বললেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব দিতে পারছেন না।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এক সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে কিছুটা আগ্রহ প্রকাশ করা হলেও এখন আর এ বিষয়ে তেমন কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সময় আছে মাত্র ৫ মাস। এখনও এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের কোন কার্যক্রম শুরু হয়নি। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে সবার মতামত নিয়ে নতুন একটি আইন করাও প্রায় অসম্ভব। এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত নামের তালিকা থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ৪ জন নির্বাচন কমিশনার নিযোগ দেবেন।
২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাব দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেয়া হয়। অবশ্য রাষ্ট্রপতি ওই সময় সরকারী দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বঙ্গভবনে ডেকে আলোচনা করেন। সব দলের প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি সার্চ কমিটি গঠন করে দেন তিনি। ওই সার্চ কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেন রাষ্ট্রপতি। এই নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আর মাত্র ৫ মাস পর আগামী বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে যাবে।
আগের দুইবার সার্চ কমিটি গঠনের পর যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি এবারও সেভাবেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেন, তা চায় না বিএনপি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগের পদ্ধতি অনুসরণ করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই, আমরা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেব। আমরা আগেরবারও রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিলাম।
নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার দায়িত্ব পালন করেন এই কমিশন। সংবিধান অনুসারেই রাষ্ট্রপতি ৫ বছরের জন্য একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তাঁকে নির্বাচন পরিচালনার কাজে সহযোগিতা করার জন্য আরও ৪ জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
২০১৭ সালে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের পর থেকেই বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে আসছে। আবার এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কোন কোন নির্বাচনে বিজয়ীও হয়েছেন তারা। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমনা কিছু রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই বলে আসছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তারা মনে করছেন এই নির্বাচন কমিশন সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে। আর সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। তাই পরবর্তী নির্বাচন কমিশনও সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠন করা যেতে পারে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে বিএনপি সমালোচনা করলেও এর বিরুদ্ধে জোরালো কোন তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি। বিএনপি এখন পর্যন্ত এ নিয়ে যেসব কথা বলেছে তা রাজনৈতিক বক্তব্য। সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করতে পারেনি সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশনের কি ধরনের সমস্যা রয়েছে। অথবা নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলেও যে নির্বাচন নিয়ে তাদের কোন প্রশ্ন থাকবে না সে বিষয়েও তারা সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি। তাই, দেশের সাধারণ মানুষ বিএনপির রাজনৈতিক বক্তব্যকে সমর্থন করতে পারছেন না।
এদিকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির সমালোচনার জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের আমলেই রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। দেশে এর আগে কোন সরকার এমন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি। এমনকি বিএনপিও এটি করেনি। বিএনপি আমলে বিতর্কিত লোককেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়, যা নিয়ে সারাদেশের মানুষের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অথচ বর্তমান নির্বাচন কমিশনে বিএনপির দেয়া নামের তালিকা থেকেও কমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠন করে তাদের বাছাই করা যোগ্য লোকদের নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেন। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য এর চেয়ে ভাল কোন প্রক্রিয়া হতে পারে না। আশা করছি, এবারও সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।
সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান করবেন। ২০১২ সালে জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়। আর ২০১৭ সালে বর্তমান নির্বাচন কমিশনও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন থাকতেই হবে এবং সেই আইনের ভিত্তিতেই কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব। তিনি বলেন, সামনে আরও একটি নির্বাচন কমিশন গঠন হতে যাচ্ছে। সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক ৪ জন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে দেশে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। উক্ত বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে যাবে। তাই এই কমিশন চাচ্ছেন এর আগেই দেশের অধিকাংশ স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে ফেলতে। এ জন্য একটি রোডম্যাপও করা হয়েছে। শীঘ্রই সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা। আর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে। তাই বর্তমান নির্বাচন কমিশন ওই নির্বাচন নিয়ে এখন কিছু ভাবছেন না।