হেফাজতের আমির বাবুনগরীর ইন্তেকাল

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা (হাটহাজারী মাদ্রাসা) অভ্যন্তরের নিজ কক্ষে বিছানায় শোয়া অবস্থায় হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। চিকিৎসক এনে অক্সিজেন দিয়ে কৃত্রিমভাবে তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা করেন। পরে তাকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী ক্লিনিক সিএসসিআর-এ উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তার জ্ঞান ফেরেনি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ ক্লিনিকে আনার পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সিএসসিআর-এর আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ আমজাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মূলত বাবুনগরীকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
হেফাজত নেতৃবৃন্দ সূত্রে জানানো হয়, গত ৮ আগষ্ট দুপুরে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনি করোনা টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করেন। তিনি স্ত্রী, ৫ কন্যা, ১ পুত্রসহ বহু আত্মীয়স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী ও অনুসারী রেখে গেছেন। হেফাজতে ইসলামের অরাজনৈতিক কর্মকা-ের বিপরীতে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে এই সংগঠনটি এবং নেতৃবৃন্দ ব্যাপকভাবে সমালোচিত। এ সমালোচিতদের মধ্যে বাবুনগরীও অন্যতম। এছাড়া সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি হয়। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন বাবুনগরী। সংগঠনের আমীর পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ছিলেন ব্যাপক সমালোচিত। এছাড়া প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় তাকে (শফী) হত্যা করা হয়েছে এমন একটি মামলারও আসামি বাবুনগরী।
দুপুরের পর বাবুনগরীর মরদেহ হাটহাজারী মাদ্রাসায় নেয়া হয়। তিনি এই মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব ও শায়খুল হাদিস, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি, চট্টগ্রাম নুরানী তালিমুল কোরান বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মঈনুল ইসলাম ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও তিনি নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মোতাওয়াল্লি, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। রাতে হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে জানাযা শেষে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমেদ শফির কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য, বাবুনগরীর নিজ বাড়ি ফটিকছড়ির বাবুনগর গ্রামে। মৃত্যুর পর বাবুনগর গ্রামে দাফনের জন্য আগ্রহী ছিলেন এলাকাবাসী। কবরও খোড়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণেই কবর দেয়া হয়। তবে দাফনের আগে তার মরদেহ নিজ গ্রাম বাবুনগরে নেয়া হয়। সেখানে আগ্রহী ও ভক্তরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর বাবুনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি পাকিস্তানের করাচি যান। সেখানে দুবছর হাদিস নিয়ে গবেষণা করে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি দেশে ফিরে ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে তিনি হাটহাজারী মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি এ মাদ্রাসার পরিচালক নিযুক্ত হন। ২০২০ সালে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
গত বছর হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর বাবুনগরীকে সংগঠনের আমির পদে অধিষ্ঠিত করে ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন ঠেকাবার নামে দেশজুড়ে নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালিয়ে সংগঠনটি চাপের মুখে পড়ে যায়। দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হয়ে যায়। অনেকেই চলে যায় আত্মগোপনে। এ অবস্থায় প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে জুনায়েদ বাবুনগরী সেই কার্যকরী কমিটি গত ২৫ এপ্রিল ভেঙ্গে দেন। এরপর গঠন করা হয় ৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি। সেই কমিটির নেতৃত্বেও ছিলেন বাবুনগরী। সর্বশেষ গত ৭ জুন এ কমিটি ৩৩ সদস্যের করা হয়। তার প্রকাশিত বেশ কিছু ইসলামিক গ্রন্থ রয়েছে।
২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হত্যার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে মুক্তি পান। ২০২০ সালের নবেম্বর মাসে দেশের ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এ বিতর্কে বাবুনগরী সংগঠনের বিতর্কিত নেতা ও বর্তমানে গ্রেফতারকৃত মামুনুল হকের পক্ষে কঠোরভাবে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দেন। এ বছর দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনে প্রতিরোধের ব্যানারে হেফাজতের পক্ষে যে তান্ডব চালানো হয় সে ঘটনা হাটহাজারী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ ঘটনায় তিনিসহ হেফাজতের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে সংগঠনের ১৩ দফা দাবিতে যে অবস্থান কর্মসূচী ও বেআইনী কর্মকান্ড চালানো হয় তার সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।
সংগঠনের অভ্যন্তরেই নেতাকর্মীদের মধ্যে তিনি বিতর্কিত ছিলেন। তার বিরুদ্ধবাদী গ্রুপের নেতা হলেন মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহী, সঙ্গে রয়েছেন শাহ আহমদ শফীপুত্র আনাস মাদানীসহ অনেকে। প্রসঙ্গত, প্রতিষ্ঠাতা আমির শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে বহুধাবিভক্তির সৃষ্টি হয়। এখন বাবুনগরীর মৃত্যুর পর মূল নেতৃত্বে কে আসছেন সেটি দেখার পালা।