জীবন হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র, ভুল করলেই হারতে হবে

7

আলী হাবিব :

নেতিবাচক কথা দিয়েই শুরু আজকের নিবন্ধ। কোথাও কোনো সুখবর নেই। গত শনিবার পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্ত হয়েছে ১২ লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৪ জন কভিড রোগী। মোট মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ৬৮৫। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে ১০ লাখ ৭৮ হাজার ২১২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে ওই দিন পর্যন্ত সক্রিয় করোনাভাইরাসের রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৫০ হাজার ৫৮৭। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তারে জুলাই মাসজুড়ে দৈনিক রোগী শনাক্ত ১০ হাজারের আশপাশে ছিল। কী অবস্থা হাসপাতালগুলোর? গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে এখন উপচে পড়া কভিড রোগী। তারা চিকিৎসা পেতে ছুটছে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে। অবস্থা সামাল দিতে এখনই অনেকটা দিশাহারা রাজধানীর একেকটি হাসপাতাল। সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিচ্ছে আইসিইউ বেডের ক্ষেত্রে। সরকারি-বেসরকারি মিলে ২২টি হাসপাতালেরই প্রায় সব আইসিইউ বেড রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। নতুন রোগী নেওয়া যাচ্ছে না খালি না হওয়া পর্যন্ত।
কেন এমন হলো? আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, পরীক্ষা, শনাক্ত, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন আমরা পরিপূর্ণভাবে এই কাজগুলো নিশ্চিত করতে পারিনি। তাঁদের আশঙ্কা, গত কয়েক দিনে সংক্রমণের যে যোগসূত্র ঘটেছে তার প্রভাব দেখা যাবে চলতি মাসের প্রথম থেকে। আর মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠবে মাঝামাঝি থেকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমাদের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আক্রান্তদের জন্য হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা। তাঁদের মতে, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার আওতায় এলাকায় এলাকায় অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টার গড়া দরকার। অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে শুধু সিলিন্ডার অক্সিজেন থাকলেই চলবে। এতে অনেকেই আইসোলেশন সেন্টার থেকেই বাসায় ফিরবে সুস্থ হয়ে। যাদের হাই ফ্লো বা আইসিইউ সেবা লাগবে, শুধু তাদেরই হাসপাতালে পাঠানো দরকার হবে। এতে হাসপাতালগুলোতে চাপ কমবে, মানুষও দ্রুততম সময়ে চিকিৎসার আওতায় আসতে পারবে। সর্বোপরি সংক্রমণের চেইন ভেঙে করোনা দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে আমরা এখন পর্যন্ত হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় কোনো দক্ষতাই দেখাতে পারিনি। গত এক বছরে হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ ছিল বলে মনে হয় না। ফলে সংকট প্রকট হয়েছে। রাজধানীর ১৬টি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে বড় তিনটিতে আইসিইউ ইউনিট চালুই করা হয়নি।
প্রতিদিন খবরের কাগজে যেসব ছবি ছাপা হচ্ছে, তা দেখলে বুক ভেঙে যায়। হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সে রোগী রেখে স্বজনরা বারবার ছুটে যাচ্ছে কোনো সিট খালি হয়েছে কি না সেই খোঁজ নিতে। আইসিইউতে কারো মৃত্যু হলে সেই বেডে আরেকজনকে নেওয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে অপেক্ষমাণ রোগীর স্বজনদের কাছে যেন আরেক রোগীর মৃত্যুই কাম্য। একটি সিট খালি হতে না হতেই উঠছে নতুন রোগী। চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত এক মা ছেলের জন্য আইসিইউ বেড ছেড়ে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রাণ হারান। এই যখন অবস্থা, তখনই আবার কভিড চিকিৎসা যেন বেসরকারি হাসপাতালে বড় ব্যবসার মাধ্যম হয়েছে। বড় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউতে থাকা রোগীদের গড়ে দিনে প্রায় এক লাখ টাকা গুনতে হয়। আবার করোনা চিকিৎসার অনুমতি না থাকলেও করোনা রোগী ভর্তির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে কোনো কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে।
টেলিফোনে আক্ষেপ করে এক চিকিৎসক বন্ধু বললেন, ‘আমরা তো ভুটানের কাছাকাছি অন্তত যেতে পারতাম।’ কী করেছে ভুটান? গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, কভিড মোকাবেলার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছে এই ছোট দেশটি। মহামারি ঠেকাতে আগাম পরিকল্পনার পাশাপাশি সংক্রমণের শুরুর দিকেই দ্রুততার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল ভুটান। এ ছাড়া গণহারে পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমণ শনাক্ত করা, কোয়ারেন্টিন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা। অথচ সে দেশে চিকিৎসক মাত্র ৩০০ জন। মহামারি মোকাবেলায় তাঁরা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ‘কভিড রেসপন্স প্ল্যান’ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে সেখানে। ভুটানে এ পর্যন্ত শনাক্ত মোট দুই হাজার ৪৮৯ জন। প্রথমবারের মতো দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় গত জানুয়ারিতে।
আমাদের সক্ষমতা একেবারে কম ছিল না। ঘাটতি ছিল আন্তরিকতায়। দৃষ্টি ছিল বাণিজ্যের দিকে। ফলে বাণিজ্যের লাভের কড়ি গুনতে গিয়ে অবহেলিত হয়েছে সেবা। কী করতে পারতাম বা এখনো পারি আমরা? এই যে রোগী নিয়ে স্বজনরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছে, এই বিড়ম্বনা থেকে বোধ হয় রেহাই দেওয়া সম্ভব। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বোধ হয় এই সুবিধা দিতে পারে। কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর একটি ডাটাবেইস তৈরি করা যেতে পারে। যেখানে কোন হাসপাতালে কয়টি আইসিইউ ও সাধারণ বেড খালি আছে সে তথ্য থাকবে। রোগীর স্বজনরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা দিয়ে বেড বুকিং দিয়ে রোগী নিয়ে গেলে ভর্তিপ্রক্রিয়া সহজ হবে। কাউকে অপেক্ষায় থাকতে হবে না। ছোটাছুটি করতে হবে না এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে।
করোনা মহামারিতে বাণিজ্যের আরো একটি দিক তুলে ধরা যাক। করোনা মহামারিকালে রোগী পরিবহনে ঢাকাসহ সারা দেশে অ্যাম্বুল্যান্সের চাহিদা বেড়েছে। এই সুযোগে অমানবিক ব্যবসার ফাঁদ পেতেছে এ্যাম্বুলেন্স চালক, মালিক ও হাসপাতালকেন্দ্রিক চক্র। বিভিন্নভাবে টাকা আদায় করে এ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া বাড়িয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এ্যাম্বুলেন্স কম থাকার সুযোগ নিচ্ছে চক্রগুলো। লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানের মালিক ও চালকরা করোনাকে পুঁজি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন। বেসরকারিভাবে লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যান সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। তাদের নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারিরও কেউ নেই। মালিকদের সমিতি থাকলেও নেই নির্দিষ্ট কোনো ভাড়ার তালিকা।
অনেক নেতিবাচক কথা হয়েছে। এবার কিছু ইতিবাচক কথা বলা যাক। এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আশা জাগানো অনেক তথ্য আছে। টিকা জোগানে মাঝে কিছুটা সমস্যা তৈরি হলেও এখন তা কেটে গেছে। নিয়মিত টিকা আসতে শুরু করেছে এবং পরিকল্পিতভাবেই টিকা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে সরকারের হাতে এক কোটির ওপরে টিকা আছে। চলতি মাসের মধ্যেই আরো দুই কোটি টিকা সরকারের হাতে চলে আসবে। চীন থেকে তিন কোটি, রাশিয়া থেকে সাত কোটি, জনসন অ্যান্ড জনসনের সাত কোটি ভ্যাকসিন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকাসহ আগামী বছরের শুরুর দিকেই সরকারের হাতে প্রায় ২১ কোটি টিকা চলে আসবে। এর মাধ্যমে দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে সক্ষম হবে সরকার। নিবন্ধনের বয়সসীমা কমানো হয়েছে। ফ্রন্টলাইনারদের সন্তানদের জন্য ১৮ বছর বয়স হলেই টিকা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকার নিবন্ধনেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা ধরে কাজ চলছে। আট কোটি ডোজ টিকা রাখার সক্ষমতা আছে আমাদের। এ ছাড়া ফাইজার-মডার্নার মতো টিকা সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার সরঞ্জাম আরো সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এত কিছুর পরও কিছু আশঙ্কা তো থেকেই যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোর তথ্য বলছে, যারা টিকা নেয়নি বা কোনো কারণে নিতে পারেনি, তারা করোনায় আক্রান্ত হলে টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষজ্ঞদেরও সেই একই অভিমত। সর্বজনীন টিকা, সর্বজনীন মাস্ক ব্যবহার করোনা সংক্রমণের হার একেবারে নিচের দিকে নামিয়ে আনতে পারে। টিকা সংগ্রহে সরকার সব ব্যবস্থা নিয়েছে। টিকা নেওয়ার দায়িত্বটি কিন্তু আমাদের সবার। নাগরিক হিসেবে আমরা যে দায়িত্বশীল, সেটা এখন প্রমাণ করতে হবে। ইসক্রা কবিতাগুচ্ছে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘বড়ো প্রয়োজন সামনে এসেছে/ছোটো প্রয়োজন ছাড়তে হবে।/জীবন হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র/ভুল করলেই হারতে হবে।’
জীবনের এই যুদ্ধক্ষেত্রে কোনোমতেই ভুল করা চলবে না। আমাদের বিজয়ী হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, ছড়াকার।